ইউনিপের কাছে জমা টাকার অঙ্ক নিয়ে বিভ্রান্তি !!

কর্মকর্তারা বিক্ষিপ্ত তথ্য দিচ্ছেন

ইউনিপের কাছে জমা টাকার অঙ্ক নিয়ে বিভ্রান্তি


ইউনিপেটুইউর গ্রাহকদের দাবি ছয় হাজার কোটি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির হোসেন বলছেন ১২০০ কোটি। পুলিশ মুনতাসিরসহ দুই কর্মকর্তাকে দুই দফায় রিমান্ডে নিয়েও প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করা টাকার সঠিক তথ্য জানতে পারেনি। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি থেকে যাচ্ছে।
গ্রাহকদের দাবি, ইউনিপেটুইউর কর্মকর্তারাই গ্রেপ্তার হওয়ার আগে জানিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে গ্রাহকদের জমা দেওয়া টাকার অঙ্ক ছয় হাজার কোটি। এখন তা কমিয়ে বলছেন। গ্রাহকদের অভিযোগ, রিমান্ডে সময় নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না বলেই আসল খবর মিলছে না।
তবে পুলিশের বক্তব্য, তারা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) গোলাম মোস্তফা গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে মুনতাসিরের দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাঁদের ওয়েবসাইটটিও বন্ধ। মুনতাসিরের নির্দেশিত পথে সারা রাত ধরে সার্ভারে ঢোকার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ঢোকা সম্ভব হয়নি। সার্ভারটি সম্ভবত ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।’
এসি গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ধারণা করছি ইউনিপের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন মালয়েশিয়ার কোনো সার্ভারে হোস্ট করা হয়েছে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি সঠিক তথ্য বের করার।’
যোগাযোগ করা হলে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি সুমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ওয়েবসাইট ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও সার্ভার যে ভবনে বা অবস্থানে আছে, সেখানে গিয়ে সার্ভার থেকে তথ্য নেওয়া সম্ভব। তবে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়াও পাবলিক আইপি পরিবর্তন করলেও সার্ভারে ঢোকা যায় না।
সুমন আহমেদ বলেন, সাধারণত যে সার্ভারে ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন হোস্ট করা হয়, সেখানে বলে দিয়ে সাইট বন্ধ করা যায়। আবার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেও তা বন্ধ হতে পারে। সার্ভার থেকে তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য একজন তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
‘প্রতারিত’ গ্রাহকদের সংগঠন ইউনিপে মেম্বারস ক্লাব লিমিটেডের সভাপতি সরোয়ার মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা সাড়ে ছয় লাখ গ্রাহকের জীবন-মরণের প্রশ্ন। তাই সঠিক তথ্য বের করতে পুলিশকে আরও উদ্যোগী ও তৎপর হতে হবে।’
ছয় হাজার কোটি টাকা জমা থাকার দাবির ভিত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউনিপে মেম্বারস ক্লাব লিমিটেডের সভাপতি সরোয়ার মোর্শেদ বলেন, গত ২০ ও ২২ মার্চ গ্রাহকদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের দুইটি বৈঠক হয়েছিল। সেখানে মুনতাসির ও জামশেদসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। জমা টাকার পরিমাণ জানতে চাইলে মুনতাসিরের কাছে দুই হাজার কোটি ও মিঠু চৌধুরীর কাছে ১৭০০ কোটিসহ মোট ছয় হাজার কোটি টাকা আছে বলে হিসাব দেখানো হয়।
সরোয়ার মোর্শেদ বলেন, ‘আমরা যে দাবি করছি, তা মুনতাসিরদেরই দেওয়া হিসাব। অথচ গ্রেপ্তারের পর থেকে তাঁরা অন্য কথা বলছেন।’
গ্রাহকদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বখতিয়ার বলেন, মুনতাসির যে টাকা আছে বলে দাবি করছেন, তার অর্ধেকের বেশি হচ্ছে শুধু হিসাব খোলা বাবদ টাকার। হিসাব খুলতে লাগত অফেরতযোগ্য সর্বনিম্ন চার হাজার থেকে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা। ৯৫ শতাংশ হিসাবই খোলা হয়েছে সর্বোচ্চ টাকা দিয়ে।
হুমকির অভিযোগ: সম্প্রতি টাকা ফেরত ও কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের দাবিতে চাঁদপুরে মানববন্ধন করেন দুই শতাধিক গ্রাহক। মানববন্ধনের পর তাঁরা ইউনিপের কর্মকর্তা সাখাওয়াত সুমনের মাদ্রাসা রোডের বাসায় যান। কিন্তু সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি।
সভাপতি সরোয়ার মোর্শেদ অভিযোগ করেন, ওই বাসা ত্যাগ করতে না করতেই সাখাওয়াত তিনিসহ কয়েকজনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে মামলার ভয় দেখিয়ে নানা হুমকি দেন। তাঁর নিযুক্ত স্থানীয় সন্ত্রাসীরাও গ্রাহকদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
বেশ কয়েকজন গ্রাহক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের আন্দোলন দমানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন পলাতক বিভিন্ন কর্মকর্তা ও তাঁদের ভাড়া করা সন্ত্রাসীরা।
মামলা ও রিমান্ড: গত ৫ মে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির হোসেন ও মহাব্যবস্থাপক জামশেদুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর মোহাম্মদপুর থানায় বিভিন্ন গ্রাহক ইউনিপের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা শুরু করেন। গতকাল পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ছিল ১২টি। আরও মামলা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
৬ মে দুটি মামলায় মুনতাসিরকে তিনদিন করে মোট ছয় দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। একটি মামলায় জামশেদের নাম থাকায় তিনিও তিন দিনের রিমান্ডে যান। এটি ছাড়া জামশেদকে আরেকটি মামলায় আরও তিনদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
গত ১৩ মে তিনটি মামলায় দুই দিন করে মুনতাসিরকে ছয় দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। জামশেদকে নেওয়া হয় চার দিনের রিমান্ডে। গতকাল বৃহস্পতিবার জামশেদের রিমান্ড শেষ হলে তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তিনটি মামলায় জামশেদ ও মুনতাসিরের আরও পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
২০০৯ সালের অক্টোবরে কথিত বহুধাপ বিপণন (এমএলএম) প্রতিষ্ঠান ইউনিপেটুইউ আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি স্বর্ণের ব্যবসা করে ১০ মাসে টাকা দ্বিগুণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে। কিছুদিন ঠিকমতো চলার পর একপর্যায়ে এটি গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া বন্ধ করে দিলে সমস্যার সূত্রপাত হয়।

Related posts

Leave a Comment