মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসায়

মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসায় নেমে ইউনিপেটুইউ কম্পানির কর্মকর্তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন সাড়ে ১২০০ কোটি টাকা। এ টাকা আত্মসাতের জন্য প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে আঁতাত করেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁরা সরিয়ে নেন সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা। মিঠু চৌধুরী নামের একজন উপদেষ্টা একাই প্রায় ২০০ কোটি টাকা নিয়ে সরে পড়েছেন। তাঁরা ব্যবসা আরো এগিয়ে নিচ্ছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের তদারকি এবং প্রতারিত গ্রাহকদের মামলায় সংকট দেখা দিলে গা ঢাকা দেন। এ রকম পরিস্থিতিতে মধ্যম সারির কর্মকর্তারাও গ্রাহকের জামানত জমা না করে নিজেদের পকেটে পোরেন।
ইউনিপেটুইউর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির ইমন ও মহাব্যবস্থাপক জামশেদুর রহমানকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এমন সব তথ্য পেয়েছে পুলিশ। অভিযুক্তরা নিজেদের আড়াল করতে ইউনিপেটুইউর নাম বদলে ‘ইউনি ল্যান্ড’ ও ‘ইউনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানও তৈরি করেছেন। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ইউনিপেটুইউর ব্যাংক হিসাবে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা পেলেও বাকি টাকা কোথায়, কিভাবে ব্যবহার হয়েছে এর কোনো হদিস মিলছে না। জমি কেনা এবং ‘প্রশাসনকে ম্যানেজ’ করতে ৪০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি করছেন অভিযুক্তরা। আত্মসাৎ করা টাকা মালয়েশিয়ায় পাচার এবং দেশে অন্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
ইউনিপেটুইউর দুই কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হওয়ার পর গত চার দিনে কয়েক শ প্রতারিত গ্রাহক রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় ভিড় করেন। গ্রাহকদের অভিযোগের পাহাড় জমেছে সেখানে। এত অভিযোগ দেখে বিপাকে পড়ে পুলিশ।
অবশেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে গত মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার প্রায় ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ছয় লাখ গ্রাহকের পক্ষ থেকে ১৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইউনিপেটুইউর উপদেষ্টা মঞ্জুরুল আহসান চৌধুরী ওরফে মিঠু চৌধুরী, চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান শাহিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির ইমন, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মিজান মুকিত, নোমান, তাহের ও গোলাম মোস্তফার যোগসাজশে সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ওই টাকার একটি বড় অংশ পেয়েছেন ইমন ও জামশেদ। টাকাগুলো কোথায় কী অবস্থায় রয়েছে তা জানার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটর করছে।
সূত্র জানায়, উত্তরা এলাকায় ইমনের পাঁচ কাঠা জমি ও একটি প্রাইভেট কার ছাড়া আর কোনো সম্পত্তির হদিস পায়নি পুলিশ। জামশেদুরের কোনো সম্পত্তিরই হিসাব নেই। টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে কি না বা হুন্ডির মাধ্যমে গ্রামের কারো কাছে গচ্ছিত রাখা হয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানের ৭৫০ কোটি টাকা উত্তোলনের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়নি, যা বিধিবহির্ভূত। ব্র্যাক ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকের শাখায় প্রতিষ্ঠানের টাকা ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
জিজ্ঞাসাবাদে ইমন ও জামশেদুর জানিয়েছেন, মুকিত নামের অবসরপ্রাপ্ত এক মেজর ও অপর এক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ইউনিপেটুইউর অপকর্ম ঢাকতে সরকারের প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে লিয়াজোঁ (যোগাযোগ রক্ষা) করতেন। প্রভাবশালী মহলকে ৪০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন গ্রেপ্তারকৃত ওই দুজন। সরকার ইউনিপেটুইউ বন্ধ করে দিলে ভিন্ন উপায়ে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেন তাঁরা। ইতিমধ্যে ইউনিপেটুইউ নাম বদল করে ‘ইউনি ল্যান্ড’ নামে একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের নামে রাজধানীর বারিধারা, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, নরসিংদী, কক্সবাজার, কুষ্টিয়ায় জমি কিনেছেন তাঁরা। সহযোগী হিসেবে ‘ইউনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানও চালু করা হয়েছে। ইমন ও জামশেদুর দাবি করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আপত্তি ওঠার পর তাঁরা বিপাকে পড়ে যান। বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁদের ৪১৯ কোটি টাকা জব্দ করে। এ সময় ইউনিপেটুইউর পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্য তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করেন। উপদেষ্টা মিঠু চৌধুরী প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কয়েক কোটি টাকা নিয়ে পরিচালক তাহের ভারত পালিয়ে গেছেন। একই সময় মাঠপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা জামানত গ্রহণ করে জমা না দিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন।
মোহাম্মদপুর থানার তিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইমন ও জামশেদুর যেসব তথ্য দিচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তারা এখনো টাকার বিষয়ে কোনো সন্তোষজনক তথ্য দিতে পারেনি।’
মিঠু চৌধুরী লাপাত্তা
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তাঁর পুরো নাম মঞ্জুরুল আহসান চৌধুরী মিঠু। কুষ্টিয়ায় তাঁর বাড়ি। ইউনিপেটুইউর উপদেষ্টা হিসেবে পরিচিত তিনি। তবে তাঁর অবস্থান এবং ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যাপক রহস্য রয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, শীর্ষ পর্যায়ের ইউনিপেটুইউর কার্যক্রম পরিচালনায় ভূমিকা ছিল তাঁর। সংক্ষিপ্ত নাম ব্যবহার করায় পুলিশ তাঁকে শনাক্ত করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়া আছেন বলে অনেকের ধারণা। এই মিঠু চৌধুরী নামে-বেনামে গাড়ি, রিয়েল স্টেট ও চলচ্চিত্র ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। একটি পুরনো জাতীয় দৈনিকের মালিকানা কিনে তিনি সম্পাদক ও প্রকাশকও হয়েছেন। গত দুই বছরে এসব ব্যবসায় তাঁর বিনিয়োগ অন্তত শত কোটি টাকা।
২০০৯ সাল থেকে রাজধানীর ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর রোডে বিলাসবহুল অফিস খুলে ইউনিপেটুইউ কার্যক্রম শুরু করে। ২০১০ সালে তাঁদের বিরুদ্ধে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার আগেই অন্তত ছয় লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ১২৫০ কোটি টাকা জামানত গ্রহণ করে তাঁরা।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, অঞ্চলভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটির কিছু এজেন্ট রয়েছে, যারা চক্রের সঙ্গে জড়িত। মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় এমন পাঁচটি বড় চক্র রয়েছে। তাদের বেনামে চালিত অফিসে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ ও সভা হয়। মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় কয়েক হাজার মানুষ এ চক্রটির প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
আসামি গ্রেপ্তার ও টাকা ফেরত না পেলে বৃহৎ আন্দোলন : গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে (ক্র্যাব) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতারিত গ্রাহকরা অভিযুক্ত অপরাপর কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান। প্রতারিত গ্রাহকদের সংগঠন ‘ইউনিপে মেম্বার্স ক্লাব’ সদস্যরা ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, এ সময়ের মধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার না করা হলে তাঁরা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করবেন। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বক্তিয়ার আসাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন।
থানায় অভিযোগের পাহাড় : মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহমুদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, গত রবিবার থেকেই শত শত গ্রাহক থানা এসে ইউনিপেটুইউর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করতে থাকে। পরবর্তী সময়ে অঞ্চলভিত্তিক অভিযোগ করতে বলা হয়। গত মঙ্গলবার রাতে পাঁচ প্রতারিত গ্রাহক থানায় সাতটি মামলা দায়ের করেছেন। দুই শত গ্রাহক আলাদা অভিযোগে ২০০ কোটি টাকার অভিযোগ করেন। গতকাল ছয়টি বিভাগ থেকে আলাদা ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া ‘ইউনিপে মেম্বারস্ ক্লাব’-এর পক্ষ থেকে সম্মিলিত অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। প্রতিটি মামলা তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। ইউনিপে মেম্বারস্ ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সরওয়ার মোর্শেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা টাকা আদায় এবং প্রতারকদের গ্রেপ্তারের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিতেই এই মামলা দায়ের করেছি। আমাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই (২৪ ঘণ্টা গতকালই শেষ হয়েছে) দাবি আদায় না হওয়ায় বৃহত্তর আন্দোলনের যাওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করছি।’
উল্লেখ্য, গত শনিবার রাতে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ ইউনিপেটুইউর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির ইমন ও মহাব্যবস্থাপক জামশেদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। গত বছরের ২৩ অক্টোবর আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তি এবং ১৫ ডিসেম্বর আশরাফ সিদ্দিক নামের আরেক ব্যক্তি মোহাম্মদপুর থানায় তাঁদের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের মামলা করেন। তাঁদের গ্রেপ্তার করে দুই

মামলায় তিন দিন করে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

Related posts

Leave a Comment