মুমিনের সফলতা যেখানে

মাওলানা শিব্বীর আহমদ :
সফলতা কে না চায়? প্রতিটি সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ সফল হতে চায় আপন কর্মে আপন ক্ষেত্রে। যেখানেই সে বিচরণ করে, সেখানেই সফলতা অর্জন করতে চায়। এ সফলতা ব্যক্তি, ক্ষেত্র, লক্ষ্য ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন মুমিনও সফল হতে চাইবে তার জীবনে। সে বিশ্বাস করেÑ এ জীবনের প্রান্থ খুব দূরে নয়। এর পর শুরু হবে এক অসীম জীবনের পথে চলা। মনে প্রাণে যে এ বিশ্বাস লালন করে, তার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে আখেরাতের জীবন। হয়তো সে সফলতা কামনা করবে দুই জীবনেই। কিংবা সসীম দুনিয়ার জীবন কোনভাবে শেষ হয়ে গেলেও তার চূড়ান্ত চেষ্টা সাধনা ও কামনাÑ অসীম পরকালীন জীবনে যাতে সে ব্যর্থ না হয়। দুনিয়ার জীবন যেহেতু ক্ষণস্থায়ী, তাই এর সফলতাও ক্ষণস্থায়ী। প্রকৃত সফলতা হচ্ছে আখেরাতের সফলতা। তাই যদি কেউ আখেরাতের অনন্ত অসীম জীবনে সফলতা ও মুক্তি না পায়, তাহলে দুনিয়াতে সে যতই সুখ বিলাসিতা ও আরামে কাটাক না কেন, সে সফল নয়। আর যদি কোন মুমিন দুনিয়ার অস্থায়ী ও স্বল্পকালীন জীবনটাকে কষ্টের ভেতর দিয়েও কাটায়, কিন্তু আখেরাতে সে জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামতরাজি লাভ করতে পারে, তাহলে সে-ই সফল।
পবিত্র কুরআনে কারীমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সফল মুমিনের পরিচয় বলে দিয়েছেন। সেখান থেকে যে কোন মুমিন তার সফলতার পথ খুঁজে নিতে পারে। সফলতার জন্যে মহান ¯্রষ্টার দেখানো যে পথ, তার চেয়ে উত্তম ও যথার্থ আর কোন্ পথ হতে পারে? সূরা মুমিনুনের শুরুটাই হয়েছে এভাবেÑ
‘নিশ্চয়ই সফলতা অর্জন করেছে মুমিনগণ! যারা তাদের নামাজে আন্তরিকভাবে বিনীত। যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে। মুমিনুন: ১-৪
এভাবে এ সূরার ৯ম আয়াত পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সফল মুমিনদের আরো কিছু গুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। আপন প্রভুর দেখানো এ রাজপথে যারা চলবে, তারাই তো তাদের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে সফলতার নাগাল পাবে। সফল মুমিনদের গুণাবলী উল্লেখ করার পর ইরশাদ হয়েছেÑ
‘এরাই তো উত্তরাধিকারী। তারা ফিরদাউসের উত্তরাধিকার লাভ করবে। তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে।’ মুমিনুন:১০-১১

এ জান্নাতুল ফিরদাউসই যে একজন মুমিনের চূড়ান্ত লক্ষ্য!
এখানে মুমিনের সফলতার জন্যে প্রথম যে দিকটির কথা বলা হয়েছে তা হলো বিনম্র নামাজ। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয়টি হচ্ছে নামাজ। কুরআনে কারীম  ও হাদীস শরীফের নানান জায়গায় নানান ভাবে উল্লিখিত হয়েছে নামাজের গুরুত্বের কথা। যত তাগিদ ও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এ নামাজের ক্ষেত্রে, তা অন্য কোন ইবাদত কিংবা বিধানের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। পবিত্র কুরআনের প্রায় ৮০ জায়গায় বলা হয়েছে নামাজের কথা। শিশু যখন সাত বছর বয়সে উপনীত হয়, তখনই তার অভিভাবককে বলা হয়েছে তাকে নামাজে অভ্যস্ত করে তোলার কথা। আর যদি দশ বছর বয়সে গিয়েও সে নামাজ না পড়ে তাহলে তাকে প্রহার করার আদেশও এসেছে। এ নামাজকে হাদীসে মুমিনের মেরাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এরকম আরো অসংখ্য হাদীস নামাজের গুরুত্ব নির্দেশ করে। কিন্তু আমাদের আলোচ্য সূরা মুমিনুনে শুধুই নামাজের গুরুত্বের কথা বলা হয় নি। কিংবা বলা যায়, সফল মুমিনের গুণ হিসেবে এখানে শুধু ‘তারা নামাজি’ এতটুকু বলেই শেষ করে নি। বরং সফল মুমিনের পরিচয় হিসেবে এখানে নির্দেশ করা হয়েছে বিন¤্র নামাজের প্রতি। আন্তরিকভাবে বিনীত নামাজের প্রতি। যে নামাজে বান্দা তার প্রভুর দরবারে দেহ-মন সঁপে দেয়। খুশু-খুযু অর্থাৎ আন্তরিক বিনয়ের সাথে নামাজ পড়ার অর্থ হচ্ছেÑ নামাজে অন্তর স্থির থাকবে আল্লাহর জন্যে, আল্লাহর ধ্যান ছাড়া অন্য সব কিছু থেকে অন্তর থাকবে মুক্ত ও পবিত্র। অন্তরের পাশাপাশি দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকেও বিরত রাখতে হবে অনর্থক নড়াচড়া থেকে। আশেপাশে এদিক-সেদিক না তাকিয়ে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ রাখতে হবে সিজদার স্থানে। নামাজের মধ্যে যে কেরাত ও দোয়াসমূহ পড়া হয়, সেগুলোর দিকেও মনোযোগী হতে হবে। এবং নামাজ হবে কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যেই, সেখানে কোন মানুষকে দেখানোর কোন উদ্দেশ্য থাকবে না। সর্বোপরি নামাজ আদায় করতে হবে অত্যন্ত মনোযোগ ও যতেœর সাথে।  নামাজে কোন ধরণের উদাসীনতা ও অলসতা যেন করা না হয়। কুরআনে কারীমেই মুনাফিকদের নামাজের বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত হয়েছে যে তারা নামাজে দাঁড়ায় অলসভঙ্গিতে।   ইরশাদ হয়েছেÑ
‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করে। আর তিনিও তাদেরকে এর শাস্তি দিয়ে থাকেন। তারা যখন নামাজে দাঁড়ায়, তখন নামাজে দাঁড়ায় অলসভঙ্গিতে। তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে থাকে।’ নিসা: ১৪২
যারা নামাজ পড়ে ঠিকই, কিন্তু অবহেলা ও উদাসীনতার সাথে, তাদের এ নামাজই তাদের জন্যে ধ্বংস ও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সূরা মাউনে ইরশাদ হয়েছেÑ
‘সে নামাজিদের জন্যে ধ্বংস, যারা তাদের নামাজে গাফলতি করে; যারা নামাজ পড়ে মানুষকে দেখানোর জন্যে।’ [৪-৬]
তাই প্রতিটি মুমিনকেই এ বিষয়ে সদাসচেতন থাকতে হবে, যেন তার নামাজে কোন ধরণের আলসেমি সৃষ্টি হয়ে তা মুনাফিকদের নামাজের সদৃশ না হয়ে যায়। নামাজে অবহেলার কারণে যেন নামাজই আবার ধ্বংসের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।
নামাজ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সামনে মানুষের দাসত্ব ও গোলামী প্রকাশের সর্বোচ্চ মাধ্যম। তাঁর সামনে সোজা দাঁড়িয়ে নামাজ শুরুর মাধ্যমে এর সূচনা হয়। আর পরিপূর্ণতা লাভ করে সিজদার মাধ্যমে। হাদীস শরীফে আছে-
‘বান্দা যখন সিজদাবনত হয়, তখনই সে তার প্রভুর সবচেয়ে কাছাকাছি চলে আসে।’ আহমদ আবু দাউদ ও মুসলিম
কিন্তু এ গোলামী প্রকাশের জন্যে যদি কেউ নামাজে দাঁড়িয়ে ইচ্ছাকৃত নানান বিষয় চিন্তা করতে থাকে, তাহলে তা তো আল্লাহর কাছে গোপন থাকে না।  তখন তার এ ইবাদত কবুল হওয়ার কী আশা করা যায়?
বিনয়ের সাথে নামাজ পড়া যদিও নামাজের কোন ফরজ বিষয় নয়, অর্থাৎ উদাসীনতার সাথে নামাজ আদায় করলেও সে নামাজ আদায়ের ফরজ থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে; কিন্তু নামাজ আল্লাহর কাছে গৃহীত ও কবুল হওয়ার জন্যে আন্তরিক বিনয় আবশ্যক। এ বিনয়ের সাথে নামাজ আদায় করাই হচ্ছে মুমিনের সফলতা অর্জনের প্রথম অবলম্বন।

 

Related posts

Leave a Comment