কবীরা গুনাহ সমূহের বর্ণনা

এ, এস, এম, রফিকুল ইসলাম নোমান :
আল্লাহর একত্ববাদের বিশ্বাসের উপর অটল থাকতে হলে আমাদেরকে কবীরা ও সগীরা গুনাহসমূহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। তবে কবীরা গুনাহ মারাত্মক, যা মানুষদেরকে কুফুরী ও মোনাফেকির দিকে ধাবিত করে।
গুনাহ দুই প্রকার। এক, সগীরা (ছোট গুনাহ) দুই. কবীরা (বড় গুনাহ)। যে গুনাহ সম্পর্কে কুরআন বা হাদীসে শাস্তির বিধান রয়েছে অথবা কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে তাকে কবীরা গুনাহ বলে। কোনো কোনো কবিরা গুনাহ অন্য কবিরা গুনাহ থেকে বড়। যেমন কুফরি করা, শিরক করা সবচেয়ে বড় গুনাহ।
নিম্নে কিছু কবিরাগুনাহ কুরআন ও হাদীস থেকে বর্ণনা করা হলো।
ব্যাপক প্রচলিত ১৬১টি কবীরা গুনাহঃ
প্রিয় পাঠক- পাঠিকা! আমি আপনাদের সুবিধার্থে আমাদের সমাজে প্রচলিত ১৬১টি কবীরা গুনাহের তালিকা রেফারেন্সসহ পেশ করলাম। যাতে আমরা অতি সহজে এসব পাপ সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে পারি এবং তা থেকে বাঁচতে পারি। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সকল প্রকার পাপ থেকে বেঁেচ থাকার তাওফীক দান করুন আমীন।
১. আল্লাহ পাকের যে কোনো প্রকারের শিরক করা। অর্থাৎ তাঁর মহান সত্তা ও গুনাবলীর সাথে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে শরীক করা। [সূরা নিসা:১১৬, কিতাবুল কাবাইর,:১৪]
২. প্রিয় নবী সা.-কে আলিমুল গায়েব বা হাজির নাজির মনে করা। (উল্লেখ্য যে, আলেমুল গায়েব বলা হয়- যিনি পূর্ব অবগতি বা কারো জানানো ব্যতীত নিজে নিজেই প্রকাশ্য গোপনীয়-সবকিছুর খবর জানেন। আর হাজির নাজির ঐ সত্তাকে বলে যার উপস্থিতি বিশেষ কোনো স্থানে সীমাবদ্ধ নয়; বরং একই সময়ে গোটা বিশ্বে সবখানে বিরাজমান এবং একই সাথে বিশ্ব জগতের প্রতিটি বস্তুকে সমানভাবে দেখেন। সহজ কথায, যিনি সর্বদা সবকিছু দেখেন তিনিই হলেন হাজির নাজির।) [সূরা নামল:৬৫, সূরা আনআম:৫০,৫৯, সূরা কাসাস:৪৪, সূরা তওবা:১১৯]

৩. কোনো নবী বা ওলীকে বান্দার প্রয়োজন পূরণকারী বা বিপদ নিরসনকারী মনে করা। [সূরা আরাফ:১৮৮]
৪. আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করা। অনুরূপভাবে কারো কবরে সিজদা করাও কবীরা গুনাহ। [আবু দাউদ:২/১০৫, নাসায়ী১/২২২]
৫. কবর পাকা করা, কবরে ফুল দেয়া বা বিশেষ দিনে বাতি জ্বালানো। [আবু দাউদ:২/১৫০, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী:১/৬৫]
৬. জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস মনে করা। [সূরা বাকারা:১৬৫]
৭. তাক্বদীরকে অস্বীকার করা বা তাক্বদীরের ফায়সালার প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়া। [কিতাবুল যাওয়াজির]
৮. শরীয়তের কোনো বিধানকে অবজ্ঞা করা। (যাওয়াজির)
নীচের কথাগুলো (৯ থেকে ১৫নং পর্যন্ত) কুফুরী কথা যা বলার দ্বারা কেবল কবীরা গুনাহই হয় না, ঈমান চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন-
৯. কেউ বলল, সে যদি খোদাও হয় তবুও তার কাছ থেকে আমি আমার হক আদায় করে ছাড়ব।
১০. স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই তোর সাথে পারে না, আমি কী করে পারব?
১১. আমার জন্য আসমানে আছেন আল্লাহ, আর জমিনে তুমি অর্থাৎ উপরে আল্লাহ নিচে তুমি।
১২. যদি কেউ অন্যের উপরে জুলুম করে এবং মজলুম ব্যক্তি বলে- হে আল্লাহ! তুমি তার তওবা কবুল করো না। আর যদি তুমি কবুল করেও নাও আমি কিন্তু কবুল করব না।
১৩. যদি কেউ বলে যে, যদি আদম আ. গন্ধম না খেতেন, তাহলে আমরা কেহই দুর্ভাগা হতাম না।
১৪. কেউ যদি বলে, নখ কাটা সুন্নত, এর জবাবে অন্যজন বলল, সুন্নত হলেও আমি তা কাটবা না। অনুরূপভাবে যদি বলে, সুন্নত কী কাজে আসবে অথবা সুন্নত তাতে কী হয়েছে? কিংবা রাখো তোমার সুন্নত- এ জাতীয় কথা বলা।
১৫. একজন অন্যকে বলল, নামায পড়ো। জবাবে সে বলল, এতো নামায পড়ে কি পেয়েছ? বা এতো নামায পড়ে কি হবে? অথবা বলল, আমি কতই না নামায পড়েছি, কি পেলাম? [মালাবুদ্দা মিনহু]
১৬. নবীজী সা. কে সর্ব শেষ নবী বলে বিশ্বাস না করা। [সূরা আহযাব:৪০, আল-ইমরান:৮১, আরাফ:১৫৮, বুখারী ও মুসলিম]
১৭. নবীজী সা.-কে বাশার বা পবিত্র মাটির তৈরী মানুষ মনে না করা। [সূরা কাহাফ:১১১, বনী ইসরাইল:৯৮,৯৫, ইসলামী আক্বীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ:৫৭৯]
১৮. নবী রাসূলগণকে মাছুম বা নিষ্পাপ মনে না করা। [সূরা আলে ইমরান:৩১, সূরা আহযাব:২০]
১৯, যে কোন নবীকে দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করেছেন বলে মনে করা। [তাফসীরে মারেফুল কুরআন:৬১৭]
২০. সাহাবায়ে কেরামকে আদেল (ন্যায়পরায়ণ) ও সত্যের মাপকাঠি বলে বিশ্বাস না করা। [সূরা বাকারা:১৩,১৩৭, শরহে নববী মুসলিম]
২১. সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা করা বা তাদেরকে গালি দেয়া অর্থাৎ খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে শুরু করে বিশিষ্ট ওহী লেখক ও প্রিয় নবীজী সা. এর সম্মানিত স্ত্রী হযতর উম্মে হাবীবা রা. এর আপন ভাই হযরত মুয়াবিয়া রা. সহ যে কোনো সাহাবীর সমালোচনা করা হারাম ও কবীরা গুনাহ। [মিশকাত:২/৫৫৪, আকীদাতুত্ত্বহাবী, শরহে ফিকহুল আকবার:২০, কিতাবুল কাবাইর:২৩৮]
২২. হক্কানী উলামায়ে কেরামের সঙ্গে বিদ্বেষভাব পোষণ করা।  [মিশকাত:১৯৭, মারেফে আকাবির:৪০১]
২৩. পিতা-মাতাকে কষ্ট দেয়া। [সূরা বনী ইসরাইল:২৩, কিতাবুল কাবাইর:৪৪]
২৪. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। [বাইহাকী, মিশকাত:৪২১, কিতাবুল কাবাইর:৪৪]
২৫. সামর্থ থাকা সত্ত্বে বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা বা প্রয়োজন পুরণ না করা। [বুখারী ও মুসলিম, কিতাবুল কাবাইর:৪৫]
২৬. লটারীর টিকেট ক্রয়-বিক্রয় করা বা লটারীর পুরুষ্কার গ্রহণ করা। [ফিকহী মাকালাত, কিতাবুল ঈমান:৯৩]
২৭.  মূর্তি, ভাষ্কর্য তৈরি করা। অনুরূপভাবে এগুলো ক্রয়-বিক্রয় করাও কবীরা গুনাহ। [আহমদ, মিশকাত:৩১৮]
২৮. কোনো প্রাণীর ছবি তোলা বা অঙ্কন করা। [বুখারী:২/৮৮০, কিতাবুল কাবাইর:১৮৩-১৮৫]
২৯. নাট্য ও নৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা বা দেখা। [মিশকাত:৩১৮]
৩০. গানবাদ্য করা বা শোনা। [তিরমিযী:২/৪৫, যাওয়াজির:২/৩৩৬]
৩১. নাচ, গান শিক্ষা করা বা শিক্ষা দেয়া। [মিশকাত:৪০৯-৪১১]
৩২. সামর্থ থাকা সত্ত্বেও অসহায় লোকের সাহায্য না করা। [সূরা বনি ইসরাঈল:২৬, মিশকাত:৪২৫]
৩৩. কারো প্রাপ্য হক বা পাওনা না দেয়া। [সূরা বনি ইসরাঈল:২৬, কিতাবুল কাবাইর:১১৮]
৩৪. সামর্থ থাকা সত্ত্বে ঋণ আদায়ে বিলম্ব করা। [মিশকাত:২৫২, কিতাবুল কাবাইর:১১৮]
৩৫. কাফের- ফাসেকদের পোষাক-আশাক ও আচার আচরণ অনুসরণ করা। [বুখারী, মিশকাত:২৭,৩৭৫, কিতাবুল ঈমান:১০৬]
৩৬. পায়জামা, প্যান্ট, লুঙ্গি ইত্যাদি গোড়ালীর নীচে পরিধান করা। [বুখারী:২/৮৬১, কিতাবুল কাবাইর:২১৭]
৩৭. নারী-পুরুষ একে অপরের আকৃতি ধারণ করা বা একে অপরের পোষাক পরিধান করা। [সূরা আহযাব:৩৩, মুসলিম:২০৫, কিতাবুল যাওয়াজির:১/২৫৮]
৩৮. এমন পাতলা বা টাইটফিট পোষাক পরিধান করা যদ্বারা সতর তথা ঢেকে রাখার অঙ্গসমূহ প্রকাশ পেয়ে যায়। [ সূরা আহযাব:৩৩, মুসলিম:২০,২০৫, কিতাবুল যাওয়াজির:১/২৫৮]
৩৯. এমন ছোট পোষাক পরিধান করা যদ্বারা পূর্ণরূপে সতর ঢাকে না। [সূরা আরাফ:২৬, মিশকাত:২৬৯, কিতাবুল যাওয়াজির:১/২৫৯]
৪০. মহিলাদের মাথার চুল কেটে মডেলিং করা বা কৃত্রিম চুল ব্যবহার করা। [কিতাবুল ঈমান:৮৯, তারগীব:৩/২০]
৪১. শ্রমিকের পারিশ্রমিক দেয়ার ক্ষেত্রে গরিমসি করা। [বুখারী, মিশকাত: ২৫৮, কিতাবুল কাবাইর:১১৯-১২০]
৪২. অন্যায় বিচার করা বা পক্ষপাতিত্ব করা। [সূরা নাহাল:১৬,৭৬, কিতাবুল কাবাইর:১৩৭-১৩৯]
৪৩. দুর্ভিক্ষ বা সংকটের সময় নিত্য প্রয়োজনীয় মাল-দ্রব্য অধিক মূল্য লাভের আশায় গুদামজাত করা। [মুসলিম, মিশকাত:২৪৬-৪৭, কিতাবুল যাওয়াজির:৩৮৭]
৪৪. জ্যোতিষী বা গণকের নিকট যাওয়া বা তার কথা বিশ্বাস করা। [মুসলিম, মিশকাত:৩৯৩, কিতাবুল কাবাইর:১৭১-১৭২]
৪৫. প্রিয়জনদের মৃত্যুতে শরীয়তের খেলাফ শব্দ উচ্চারণপূর্বক চিৎকার করে ক্রন্দন করা। [মিশকাত:১৫০, কিতাবুল কাবাইর:১৮৫-১৮৮]
৪৬. অন্যের ঘরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা বা উঁকি মেরে দেখা। [সূরা নূর: ২৭, গুনাহে বে লায্যত:২]
৪৭. ফরজ বা জরুরী পরিমাণ ইলম অর্জন না করা। [ইবনে মাযাহ, মিশকাত:২]
৪৮. ইলম অনুযায়ী আমল না করা। [বুখারী, মুসলিম:১/১৫৫-১৫৬]
৪৯. নিজ স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রয়োজনীয় ইলম এবং আদব শিক্ষার ব্যবস্থা না করা। [সূরা তাহরীম:৬, তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন]
৫০. আপন স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে শীয়তের খেলাফ চলতে সুযোগ দেয়া বা এ ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শন করা। [মিশকাত:১৮, কিতাবুল কাবাইর: ১৪৪-১৪৫]
৫১. কুরআন শরীফ শিখে ভুলে যাওয়া। [আবু দাউদ, মিশকাত:১৯১, কিতাবুল যাওয়াজির:১/১৯৯]
৫২. অন্যায় ও গোনাহের কাজে সমর্থন, সহায়তা ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করা। [সূরা মায়িদাহ:৪২, কিতাবুল ঈমান:১০২]
৫৩. ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অন্যায় কাজে বাধা না দেয়া। [মুসলিম, মিশকাত:৪৩৬, কিতাবুল ঈমান:১০২]
৫৪. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে থাকা সত্ত্বেও ইসলামী আইন প্রবর্তন না করা। [কিতাবুল ঈমান:১০৪]
৫৫. সৎ ও আমানতদার, যোগ্য লোকের পরিবর্তে অসৎ, খেয়ানতকারী, অযোগ্য লোককে (আত্মীয়তা বা অন্য কোনো স্বার্থের বশবর্তী হয়ে) নির্বাচিত করা। [কিতাবুল ঈমান:১০২]
৫৬. কোনো মুসলমানকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া। [বুখারী:১/৬, কিাতাবুল কাবাইর:১২০]
৫৭. কোনো সৃষ্টিকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া। যেমন- জবেহকৃত পশুর রূহ বের হওয়ার পূর্বেই বা মাছ ইত্যাদি না মেরে তার চামড়া তুলে ফেলা বা কোনো জীব-জন্তু ও কীট পতঙ্গকে আগুনে পুড়িয়ে বা পানিতে চুবিয়ে মারা। [মুসলিম, মিশকাত:৩৫৭, কিতাবুল কাবাইর:১৩২-১৩৩]
৫৮. আত্মহত্যা করা। [সূরা নিসা:২৯-৩০, বুখারী, মুসলিম মিশকাত:৩৫৭, কিতাবুল কাবাইর:১৩২-১৩৩]
৫৯. জন্ম নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা গর্ভের সন্তান নষ্ট করা। [আহসানুল ফাতাওয়া:৮/৩৪৭-৩৫৩]
৬০. জমিনের সীমানা বা আইল ভেঙ্গে সীমানা পরিবর্তন করে অন্যের জমি গোপনে দখল করা। [মুসলিম, ফয়জুল কালাম, কিতাবুল ঈমান:৮৯, কিতাবুল যাওয়াজির:১/৪২৯]
৬১. সুন্দরী প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করা বা তাতে অংশ গ্রহণ করা। [সূরা নূর:৩১, সূরা আরাফ-২৬]
৬২. খাজা বাবার গান, যাত্রানুষ্ঠান বা জারি গানের আসর বসান বা তাতে অংশ গ্রহন করা। [মিশকাত:৩১৮, কিতাবুল ঈমান: ৮৯]
৬৩. এক সঙ্গে তিন তালাক প্রদান করা। (যদিও এক সাথে তিন তালাক দিলে তালাক পতিত হয়ে যায়, কিন্তু কাজটি কবিরা গুনাহের অন্তুর্ভুক্ত) [নাসাঈ, মিশকাত:২৮৪]
৬৪. পেশাব থেকে শরীর ও পোশাককে পবিত্র না রাখা। [বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাযাহ:২৭]
৬৫. পুরুষের জন্য সোনা বা অন্য কোনো ধাতব দ্রব্যের আংটি বা অন্য কিছু ব্যবহার করা। (তবে পুরুষগণ ইচ্ছা করলে চার আনা পরিমাণ রৌপ্য নির্মিত আংটি ব্যবহার করতে পারে। ) [বুখারী, মুসলিম ও মিশকাত:৩১৮]

চলবে।….

Related posts

Leave a Comment