ভালোবাসার গল্প : শেষমানব

ভালোবাসার গল্প : শেষমানব

ভালোবাসার গল্প : শেষমানব

লিখেছেন: মারুফা তামান্না

খুব ভোরে উঠে দিম্যান ফড়িং গুনতে শুরু করেছে। ফড়িং গুলো রং বেরঙের। লাল ফড়িঙ এর আধিক্যতা আজও বেশী। লাল রং দিম্যান একটুও সহ্য করতে পারেনা।মানুষের রক্তের রং লাল।তার মনে হচ্ছে ফড়িঙ নয়, রক্তের খেলা জমে উঠেছে। চিৎকার করে শ্যারনকে ডাক দেয় দিম্যান! : শ্যারন!!! হোয়াট দা হেল, হেয়ার!!!? : সরি, দিম্যান আমি বুঝতে পারছিনা আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?? : তুমি কি দেখতে পাওনা, রেড ইজ এভরিহোয়ার। দিস ইস বুলসিট। রিমুভ ইট। : দুঃখিত দিম্যান। ফড়িঙ এর নতুন ঝাঁক এখনও তৈরী হয়নি। আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে দিম্যান। : লিভ দি প্লেস রাইট নাও।(অত্যন্ত চেঁচিয়ে). শ্যারন চলে যায়। দিম্যান বুঝতে পারে এইসব যন্ত্র দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। তারা কি আর ফিলিংস বোঝে! তারা শুধু দিম্যানের হুকুমের গোলাম। বেশ কিছুদিন ধরেই বিষয় টা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে।কিন্তু কার কাছে সে যাবে! কাকে সে মনের কষ্ট তুলে ধরবে! পুরো পৃথিবীতে সেই যে শেষ জীবিত মানব।

সে ছাড়া পৃথিবীতে যা আছে সব যন্ত্র, সব অমানুষ, প্রাণহীন যন্তু। কৃত্রিম গাছ লাগানো আছে সমস্ত শহরের ওলিগলিতে। সেগুলো থেকে কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন বের হয়। সবখানের অক্সিজেন এর পরিমান সমান। স্বাভাবিক বাষ্পের চেয়ে সামান্য বেশী অক্সিজেনের শতকরা পরিমান,প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ। কৃত্রিম ওজন স্তর বানানো হয়েছে।

যখন পৃথিবীর সমস্ত মানুষ মারা যায় তখন ওজন স্তরের ৫০ভাগই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। হিমালয় ধ্বসে গিয়ে মহাপ্লাবন হয়ে ছিল। রেড ডেভিল নামক এক সাইক্লোনে ৭০০ কোটি মানুষই মারা যায়। বেঁচে ছিল শুধু দিম্যান। কারণ এই মহাদূর্যোগে সে পৃথিবীতে ছিলনা। মহাকাশ গবেষণায় মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। সে যাত্রাও খুব একটা সফল হয়নি। দুই জন সঙ্গীর অক্সিজেন ট্যাঙ্কে ফাটল ধরে মারা যায়। দিম্যান কোনমতে পৃথিবীতে বেঁচে ফিরে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। পুরো মরুভূমি হয়ে ছিল সমস্ত পৃথিবী। স্পেসশিপে কাটিয়েছে দিনের পর দিন। কাজ করেছে কিছু প্রাণহীন রোবোর সাথে। তার শহরের বিস্তার এখন ১৪ হাজার কিলোমিটার।

বয়স এখন ৪৫ এর কাছাকাছি হবে। জীবন যৌবনের প্রায় শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে দিম্যান।এ যান্ত্রিক জীবনে তার সঙ্গীর অভাব নেই। রাত হলেই রোবোনারীরা চলে আসে ঘরে। নৃত্য দেখায়। জৈবিক চাহিদা মেটায়। কিন্তু অনুভূতিহীন যন্ত্রগুলো তার মনের চাহিদা মিটাতে পারেনা। আর কতদিন এভাবে? সে পুরো ভেঙ্গে পড়ে। হাতে পটাসিয়াম সায়ানাইড ধরে ভাবে আজকেই শেষ করে ফেলবে সব। কি দরকার তার এই পৃথিবীতে? মাথায় তাজ নিয়ে সে কিসের উল্লাস করবে? হঠাৎ বার্তা আসে তার কম্পিউটারে। : (ধাতব কণ্ঠে) দিম্যান,আপনার জন্য একটি সুসংবাদ আছে। অনুভূতি সম্পন্ন একটি নারীরোবো বানাতে সক্ষম হয়েছেন আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ প্রফেসর রোবো ন্যারাল্ড। আজ রাতে রোবো ন্যারাল্ডের বাসায় আপনার নিমন্ত্রণ। ধন্যবাদ।

ধ্যাৎ। আবার এই সব রোবোনারী। ফিলিংস না কচু থাকবে। মনে মনে ভাবে দিম্যান।

বিকেলে সে বেড়িয়ে পরে। তবে ন্যারাল্ড এর বাড়ির উদ্দেশ্যে নয়। প্রাণের খোঁজে, কোথাও কোন প্রাণ তাকে একমাত্র শান্তি দিতে পারে। তার তৈরীকৃত ব্লাড সেনসিটিভ যন্ত্র হাতে নিয়ে সে খোঁজ করতে লাগল। কারণ সে জানে সে মারা পড়লে সমস্ত মানব সম্প্রদায় বিলীন হয়ে যাবে। কোনো ব্যবস্থা তো তাকেই করতেই হবে। সারাদিন ঘুরে কোন প্রাণের সন্ধান মিললনা। নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরল দিম্যান। এসেই দেখে রেড সিগন্যাল জ্বলছে তার কম্পিউটারে। রিসিভ করাতেই ভেসে উঠল আবার সেই ধাতব স্বর।

: দিম্যান, আপনি কোথায়? আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা কেনো!! সিগন্যাল ছাড়া আপনি কেনো বাহিরে গিয়েছেন? আমাদের নেটওয়ার্ক ডাউন হয়ে গিয়েছে। আপনার চোখ আমাদের পাসওয়ার্ড। আমরা সিস্টেমে ঢুকতে পারছিনা। আপনি অতিসত্তর আপনার ক্যাপসুলে প্রবেশ করুন। লগইন করুন।

সারাদিন বাহিরে ঘুরে দিম্যান অনেক টায়ার্ড। ক্যাপসুলে প্রবেশ না করেই ঘুমিয়ে গেছে। ওদিকে রেড এলার্ম বেঁজেই যাচ্ছে। আজ মডুলেটর দিম্যানকে রঙিন স্বপ্ন দেখাল। এই ২১৫০ সালে একটি লাল শাড়ি পড়া মেয়ে কপালে লাল টিপ দিয়ে বসে আছে বধু বেশে। যেনো দিম্যানের অপেক্ষা করছে সে। দিম্যান এগিয়ে গেলো মেয়েটির কাছে। মেয়েটি লজ্জা পেলো। স্বপ্নের মধ্যেই এক জীবন্ত অনুভূতি তার শরীরে আবেগের ঝড় বয়ে দিল।

: তুমি কে মেয়ে?? [স্বপ্নে দিম্যান বলল] : আমি আপনার কল্পনা, দিম্যান। : তার মানে তুমি সত্য নও? : আমি সত্য আবার সত্য নয়! : এ কেমন কথা? তুমি খুলে বলো। : আমি আপনার প্রাণের সন্ধানের চিন্তা থেকে উদ্ভুত কিছু এলোমেলো কল্পনার সমষ্টি। : আমি কি স্বপ্ন দেখছি? : না আপনি মধ্যাবস্থায় আছেন। : আমি তোমার কথার আগামাথা কিছুই বুঝছিনা। প্লিজ ক্লিয়ার করো। : আমি কে তা জানা এখন জরুরী নয়, আপনি ক্যাপসুলে সাইন ইন করুন। পরিস্থিতি আশংকাজনক। আপনি আসলে অর্ধমৃত মানুষ, আপনাকে রোবো ন্যারাল্ড ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। আপনি যে চলাফেরা করেন তা প্রোগামিং এর মাধ্যমে, আপনি আজ সিগন্যাল এর বাইরে গিয়ে অনেক ভুল করেছেন।আপনাকে বাঁচিয়ে রাখাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আপনার বুদ্ধি মত্তা কাজে লাগিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করা হচ্ছে। আপনার মাথার সাথে একটা থাউজেন্ট কোরের প্রসেসর লাগানো আছে যার মাধ্যমে আপনার ব্রেন স্ক্যান করে সব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। : আমি কি এখন মৃত? : আমার অনুরোধ ক্যাপসুলে প্রবেশ করুন।পরে সব জানতে পাবেন।

ঘুম ভেঙ্গে গেল দিম্যানের। তাড়াতাড়ি ক্যাপসুলে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেন।কিন্তু ক্যাপসুলে ভেসে উঠল। ***You are rejected *** আবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারছেনা। ১০ /১২ বার ট্রাই করার পর লগ ইন সম্পন্ন হল। সে যাত্রায় দিম্যান বেঁচে গেলো।

তবে কিছুই সে বুঝতে পারছেনা স্বপ্নে আসা মেয়েটি কে! কথাগুলো কি সত্য? না শুধুই বিচ্ছিন্ন কল্পনার অংশ?? একবার ন্যারাল্ডের বাসায় যাওয়া যাক!

ন্যারাল্ডের বাসায় গিয়েই হতবাক হয়ে গেলেন দিম্যান। সেই লাল শাড়ি পড়া মেয়েটি সোফায় বসে আছে। ন্যারাল্ড তার হাত দিয়ে ইশারা করাতেই মেয়েটি উঠে চলে গেলো।

: দিম্যান, আপনাকে স্বাগতম। আমন্ত্রণ দেরীতে হলেও গ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ।

: আপনাকেও ধন্যবাদ, রোবো ন্যারাল্ড। কিন্তু, এই মেয়েটি কে?

: আপনাকে তো বার্তা দেওয়া হয়েছিল, দিম্যান।

: কিন্তু এই মেয়ে রোবো হতে পারেনা, রোবো ন্যারাল্ড!

: দুঃখিত। আমি প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আপনাকে কালকের স্বপ্নটি দেখানোর জন্য। স্বপ্নটি অনেক খানিই সত্য। এবং আপনার ধারণাও সম্পূর্ণ সঠিক। মেয়েটি মানব সম্প্রদায়ের একজন।

: তাহলে আমাকে এতদিন জানানো হয়নি কেনো?

: আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার জন্য এটা জরুরী ছিল।আর আপনি যখন পৃথিবীতে এসেছিলেন তখন আমিই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখি, কারণ মানুষ ছাড়া আমাদের কোন অস্তিত্ব নেই। আমাদের এনার্জি অক্সিজেন নয় ইলেক্ট্রিসিটি। মানুষ মরণশীল কিন্তু আমরা মরণশীল নই। আমরা ইলেক্ট্রিসিটি পেলে আবার জীবিত হই।

: এসব আমাকে এখন বলছেন কেনো?

: আপনাকে সব জানানোর জন্যই কালকে আমন্ত্রণ করেছিলাম।আসলে পৃথিবীতে মহাপ্রলয় আমরাই ঘটিয়েছি। আমরা পৃথিবীতে রাজত্ব করতে চেয়েছিলাম। আমরা শরীরে ফিলিংস চিপও লাগিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা বিপন্ন হয়ে পড়েছিলাম মানুষ বিহীন। আপনি ফিরে আসলে আমরা যেনো এনার্জি ফিরে পাই।

: তাহলে এ মেয়েটি কিভাবে আসল??আপনি তো বলেছিলেন আমিই শেষ মানব! তবে?

: আমরা একটি মানব শিশু বাঁচিয়ে রেখেছিলাম নিজেদের প্রয়োজনেই। তার বয়স কাল আঠারো পূর্ণ হয়েছে তাই এত ঘটা করে আমন্ত্রণ করেছিলাম। এখন পৃথিবী বাসযোগ্য মানব সম্প্রদায়ের জন্য। আমরা দুঃখিত। মানুষই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। আমরা ভুল করেছি। পৃথিবীকে নতুন করে সাজান।আমরা মানুষের ভৃত্য হয়েই থাকব।

: দেরী করে হলেও বুঝেছেন। আপনি ক্ষমার অযোগ্য।

: জ্বী। আপনি এখন ত্রিনয় (মেয়েটি)এর সাথে থাকতে পারেন।

: ধন্যবাদ, রোবো ন্যারাল্ড।

আবার পৃথিবী মানব সম্প্রদায়ে ভরে গেছে। এখন রোবো আর মানুষ পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছে সভ্যতার উন্নয়নে….. রোবোর আধিক্যের কারণে আর অমরণশীল গুণ থাকায় তারা নিজেদেরকে মানুষের চেয়েও উন্নত ভাবতে শুরু করেছিল।কিন্তু পরে ঠিকই তাদের ভুল ভেঙ্গেছিল।………

Related posts

Leave a Comment