জান্নাতের পরিচয় : জান্নাতের শরাবে নেশা এবং উম্মাদনা থাকবেনাঃ

সৈয়দা সুফিয়া খাতুন :

জান্নাতের শরাবে নেশা এবং উম্মাদনা থাকবেনাঃ
জান্নাতীরা তৃপ্তির জন্য শরাব পান করবে। কিন্তু সে শরাব হবে সুগন্ধিময়। জান্নাতের শরাব পান করে কেউ মাতাল হবে না, জ্ঞানশূন্য হবে না, পেটের কোন সমস্যা হবে না, কথায় কোন পরিবর্তন আসবে না।
সূরা সাফ্ফাতে ইরশাদ হয়েছে-‘তাদের মাঝে ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করা হবে স্বচ্ছ-শুভ্র পানীয়ের পানপাত্র, যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু, তাতে মাথা ব্যাথা হবে না এবং তা পান করে মাতালও হবে না।   সূরা সাফ্ফাত:৪৫-৪৭
সূরা তূরে ইরশাদ হয়েছে, ‘শরাব পানের কারণে তারা কোন ধরনের অসার অবান্তর কথা বলবে না, কোন ধরনের গুনাহের কাজও করবে না।’
সূরা দাহরে ইরশাদ হয়েছে – ‘আর তাদের রব তাদের খুবই পবিত্র পানীয় পান করাবেন।’সূরা দাহর:২১
হযরত আবু কেলাবা এবং ইবরাহীমের বর্ণনায় রয়েছে, জান্নাতের শরাবকে ‘শারাবান তাহুরা’ বলা হয়েছে, কেননা তা পেশাবে পরিণত হবে না; বরং মেশকের মত সুঘ্রাণযুক্ত ঘাম হয়ে বের হয়ে যাবে। এর পদ্ধতি হলো, জান্নাতীরা যখন খাওয়া দাওয়া শেষ করবে তখন তাদের সামনে শরাব পেশ করা হবে। তা পান করলে তাদের পেট পরিস্কার হবে। তারা যা খেয়েছে, শরীর  থেকে ঘাম বের হওয়ায় তা হজম হয়ে যাবে।  সে ঘাম খুবই সুঘ্রাণযুক্ত এবং স্বচ্ছ হবে। এভাবেই তাদের পেট খালি হবে এবং পুনরায় খাওয়ার চাহিদা সৃষ্টি হবে। মুকাতেল (রহঃ) বলেন, শরাবে তাহুরা জান্নাতের দরজার বাইরে একটি ঝর্ণা। যে ব্যক্তি সে ঝর্ণা থেকে পান করবে, আল্লাহ তা’আলা তার অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে দিবেন।
জান্নাতীদের বাহনঃ
হযরত বারিরা (রাঃ) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সা. জান্নাতে কি ঘোড়া থাকবে? হুযূর সা. ইরশাদ করেন, যদি আল্লাহ পাক তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান আর যদি তুমি সেখানে লাল ইয়াকুতের ঘোড়ার উপর সওয়ার হতে ইচ্ছা কর, তাহলে তোমাকে তা দেয়া হবে। সে ঘোড়া তোমাকে নিয়ে জান্নাতে উড়বে, তুমি যেখানে যেতে চাও সেখানে নিয়ে যাবে। অতঃপর আরেক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সা. জান্নাতে কি উটও থাকবে? হুযূর সা. তাকে প্রথম ব্যক্তির মত উত্তর না দিয়ে বললেন, যদি আল্লাহ পাক তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান তাহলে তোমার মন যা চায় তাই পাবে, যা দ্বারা তোমার আত্মতৃপ্তি হবে। তিরমিযী শরীফ
একদা পল্লী অঞ্চলের একজন সাহাবী হুযূর সা. এর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সা. আমি ঘোড়া খুবই পছন্দ করি, জান্নাতে কি ঘোড়া থাকবে? হুযূর সা. ইরশাদ করলেন, যদি তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় তাহলে তোমাকে ইয়াকুতের ঘোড়া দেয়া হবে। যার দুটি পাখা থাকবে। তোমাকে তাতে চড়ানো হবে, আর তুমি যেখানে যেতে চাও তোমাকে সেখানে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।   তিরমিযী
জান্নাতবাসীদের পারস্পরিক মহব্বত
সুরা হিজ্রে এরশাদ হয়েছে-
‘আর তাদের অন্তরে যে বিদ্বেষ ছিল আমি তা দূর করে দিব, তারা পরস্পর ভাইয়ের মত থাকবে, সামনা সামনি আসনে বসবে।
দুনিয়ায় যদি কারো সাথে হিংসা বিদ্বেষ  থেকেও থাকে জান্নাতে প্রবেশের পূর্বে সকলের অন্তর থেকে সব হিংসা-বিদ্বেষই বের করে দেয়া হবে। যাতে করে জান্নাতের মত পবিত্র স্থান হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত পবিত্র থাকে।বোখারী এবং মুসলিম শরীফের এক হাদীস রয়েছে:
‘জান্নাতবাসী সকলের অন্তর এক ব্যক্তির অন্তরের মত হবে। তাদের পরস্পরের মধ্যে কোন মতবিরোধ বা হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না।
অন্তর ভিন্ন ভিন্নই হবে, কিন্তু অন্তরের অবস্থা সকলের একই ধরনের হবে। অর্থাৎ একে অপরের মধ্যে এক চমৎকার প্রতির বন্ধন সুদৃঢ় থাকবে। হযরত আবু উমামা রা. বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ পাক তাদের অন্তর থেকে হিংসা বিদ্বেষ বের না করে দিবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। অবাঞ্ছিত জিনিস যেমন সরিয়ে  দেয়া হয়, তেমনি আল্লাহ পাক মোমিনদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ বের করে দিবেন। ইবনে কাসীর
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, যখন মোমিন বান্দারা (পুলসেরাত পার হয়ে) জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে, তখন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে একটি পুলের উপর তাদের দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর দুনিয়ার জীবনে পরস্পরে যে জুলুম করেছিল তার কেসাস নেয়া হবে। যখন তারা জুলুমের অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে তখন তাদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে। সে সত্তার কসম যার হাতে মুহাম্মদের জান! তাদের প্রত্যেক ব্যক্তিই জান্নাতে নিজের ঠিকানা এমন ভালভাবে চিনবে যেমন চিনতো দুনিয়াতে তাদের নিজস্ব ঠিকানা। বুখারী শরীফ
জান্নাতে প্রবেশের পূর্বেই যখন সকল অভিযোগ, অধিকার ও জুলুমের ফয়সালা হয়ে যাবে এবং অন্তর থেকে হিংসা বিদ্বেষ বের করে দেয়া হবে, তখন দুশমনীর কোন কারণই থাকবে না। তখন প্রত্যেক আদনা জান্নাতীও মনে করবে, আমাকে যা দান করা হয়েছে তা আর কাউকেই দান করা হয়নি। অতএব হিংসা সৃষ্টি হওয়ার কোন কারণই থাকবে না।
জান্নাতীদের হাসি-ঠাট্টা
সূরা তূরে ইরশাদ হয়েছে-
‘সেখানে তারা পরস্পরে শরাবের পাত্র ছোঁড়াছুঁড়ি করবে, তাতে (নেশা থাকবে না, তাই) তারা বকাবকি করবে না, আর তাতে অনর্থক কথাও থাকবে না।
এ ছোঁড়ছুঁড়ি আনন্দ এবং হাসি কৌতুকের জন্য হবে। সেখানে কারো কোন বস্তুর কমতি হবে না।
বন্ধু-বান্ধব একত্রে থাকলে হাসি-ঠাট্টা হয়েই থাকে। জান্নাতেও তেমনি হবে।
জান্নাতীদের পোশাক ও অলংকার
সূরা কাহফে এরশাদ হয়েছে-
‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আমি  সেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কার নষ্ট করি না, তাদের জন্য রয়েছে সর্বদা বসবাসের জান্নাত, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত থাকবে। তাদের তথায় স্বর্ণের অলংকার এবং সবুজ রংয়ের কাপড় পরিধান করানো হবে, এমতাবস্থায় তারা আরামদায়ক আসনে আসীন হবে। চমৎকার প্রতিদান; আর কতই না আরামের স্থান। (সূরা কাহ্ফ: )
এ আয়াতে জান্নাতীদের স্বর্ণের অলংকার পরিধান করানোর কথা বলা হয়েছে। আর সূরা দাহরে বলা হয়েছে, তাদের রূপার অলংকার পরিধান করানো হবে। উভয় আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়, জান্নাতীদের স্বর্ণ এবং রূপা উভয় ধরনের অলংকারই পরানো হবে।
দ্বিতীয়তঃ বলা হয়েছে, তাদের ‘সুন্দুস’ এবং এস্তাবরাকের সবুজ কাপড় পরিধান করানো হবে। সুনদুস- পাতলা রেশমী কাপড় আর এসতাবরাক- মোটা রেশী কাপড়কে বলা হয়। মোটা এবং পাতলা উভয় ধরনের কাপড়ের ব্যবস্থাই জান্নাতে থাকবে। যার যখন যে ধরনের কাপড় পরিধানের ইচ্ছা হবে সে ধরনের কাপড়ই পরিধান করতে পারবেন তারা।
আল্লামা বায়যাবী লেখেন, উভয় ধরনের কাপড়ের কথা এজন্য উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে মনের চাহিদা এবং চোখের আকর্ষণ অনুযায়ী সবকিছুই পাওয়া যাবে। আল্লামা বায়যাবী আরো লেখেন, সবুজ রং সব রং থেকে উত্তম বলে বিবেচিত। তার সাথে কোন রংয়ের তুলনাই হয় না। আলোচ্য আয়াতে শুধু সবুজ রংয়ের কথা বলে অন্য রংয়ের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। যদি জান্নাতী বান্দারা অন্য কোন রংয়ের কাপড় পরিধানের ইচ্ছা করে, তাহলে তাদের সে ধরনের কাপড়ও প্রদান করা হবে।
সূরা হজ্বে ইরশাদ হয়েছে-
‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের দাখিল করবেন জান্নাতে। যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তাদের তথায় স্বর্ণ কংকণ ও মুক্তা দ্বারা অলংকৃত করা হবে এবং সেথায় তাদের পোশাক হবে রেশমী।’
উক্ত আয়াত থেকে বুঝা গেল, জান্নাতীদের মুক্তার অলংকারও পরিধান করানো হবে।
হযরত আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, মোমিনের অলংকার সেখান পর্যন্ত পৌঁছবে যেখান পর্যন্ত ওযুর পানি পৌঁছেছে।
এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, শুধু হাতেই অলংকার পরানো হবে না; বরং যেখান পর্যন্ত  ওযুর পানি যাবে সেখান পর্যন্ত অলংকার পরানো হবে।
হযরত সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, জান্নাতে যা কিছু রয়েছে তার মধ্য থেকে যদি এতটুকু পরিমাণ (এ দুনিয়াতে) প্রকাশ পায় যা একটি  নখে উঠিয়ে নেয়া যায়, তাহলে আসমান এবং জমিনের যা কিছু আছে তার সবকিছুই আলোকিত হয়ে যাবে। আর যদি জান্নাতীদের একজন (দুনিয়ার দিকে) ঝুঁকে দেখে, যার ফলে তার কংকণ প্রকাশ হয়ে যায়, তাহলে সূর্য এমন আলোহীন হয়ে যাবে যেমন সূর্যের কারণে তারকাগুলো আলোহীন হয়ে যায়।

Related posts

Leave a Comment