যে ভালবাসা ঈমানের দাবী

উসমান বিন আব্দুল আলী :
সাহাবায়ে কেরাম রা. -এর প্রতি মুহাব্বত
হযরত সাহাবায়ে কেরামের প্রতি ভালবাসা রাখা ঈমানের অংশবিশেষ। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-
‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়, তুমি তাদেরকে রুকূকারী, সিজদাকারী অবস্থায় দেখতে পাবে। তারা আল্লাহর করুণা ও সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করছে। তাদের আলামত হচ্ছে, তাদের চেহারায় সিজদার চিহ্ন থাকে। আল-ফাত্হ: ২৯
তিনি আরো বলেন-
‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার হাতে বাই‘আত গ্রহণ করেছিল; অতঃপর তিনি তাদের অন্তরে কি ছিল তা জেনে নিয়েছেন, ফলে তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে পুরস্কৃত করলেন নিকটবর্তী বিজয় দিয়ে । আল-ফাত্হ: ১৮
অন্য স্থানে তিনি ইরশাদ করেন- ‘আর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম ও অগ্রগামী এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে যথাযথভাবে, আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। আর তিনি তাদের জন্য তৈরী করে রেখেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য।
রাসূল সা. বলেন- ‘আমার সাহাবাকে মন্দ বলো না। কেননা, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি (পাহাড়) পরিমাণ স্বর্ণও (আল্লাহর রাস্তায়) দান করো, তবুও তাঁদের (সাহাবাদের) দানের সমতুল্য হবে না। সহীহ বুখারী:৩৬৭৩, সহীহ মুসলিম:২২২/২৫৪১, দারুস্সালাম:৬৪৮৮
নবী করীম সা. আরো বলেন- ‘আমার সাহাবাদেরকে সম্মান কর।’ নাসায়ী ফিল কুবরা: ৫/২৮৭, হা. ৯৬৬৬ ইহার সনদ হাসান
মুহাম্মদ বিন হানাফিয়্যাহ রা. হযরত আলী রা. কে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূলের পর মানুষের মধ্যে উত্তম কে? আলী রা. বলেন, আবু বকর রা.। আবার জিজ্ঞসা করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, উমর রা.। সহীহ বুখারী: ৩৬৭১
হযরত আলী রা. আবু বকর ও ওমর রা.কে এই উম্মতের মাঝে মহানবী সা. -এর পর সর্বোত্তম ব্যক্তি বলেছেন।  আলী রা. -এর এই কথার মাঝে ঐ সমস্ত লোকদের শিক্ষার বিষয়  রয়েছে যারা শুধু আলী রা.কেই মুহাব্বত করে। সুতরাং আলী রা.-এর মুহাব্বতের দাবীদারদের জন্য আবশ্যক, তারা আবু বকর রা. ওমর রা. সহ সকল সাহাবায়ে কেরাম রা.কে ভালবাসা।
প্রশিদ্ধ তাবেঈ মায়মুন বিন মেহরান রহ. বলেন- ‘তিনটি জিনিস (চিরদিনের জন্য) ছেড়ে দাও: এক মুহাম্মদ সা. -এর সাহাবাদেরকে গালি দেয়া। দুই জ্যোতির্বিদদের সত্য বলে বিশ্বাস করা। তিন তাকদীর অস্বীকার করা। ফাযায়েলে সাহাবা, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল কর্তৃক অনুদিত:১/৬০ হা. ১৯।
হাফেজ ইবনে কাসীর সুন্দরই বলেছেন- ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নিকট সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম ন্যায় ও নির্ভরযোগ্য। আল্লাহ তা’আলা তার কালামে পাকে তাদের প্রশংসা করেছেন।  সুন্নতে নববীতে তাদের চরিত্র, কাজ-কর্মের প্রশংসা বিদ্যমান। তাঁরা আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভে তার কাছ থেকে নেকী পাওয়ার আশায় নিজেদের জান, মাল, সহায়-সম্পত্তি সবকিছু আল্লাহর রাসূলকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। ইখতেসার উলূমুল হাদীস: ১৭৬/১৭৭, ৩৯তম প্রকার।
হে আল্লাহ আমাদের অন্তরে সাহাবায়ে কেরামদের ভালবাসা বাড়িয়ে দাও। আমিন। (হাদীস: ২)

খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রতি ভালবাসা
প্রশিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু আব্দির রহমান সাফিনা রা. রাসূল সা. -এর গোলাম হতে বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেন-
‘খেলাফতে নবুওয়াত ত্রিশ বছর থাকবে। এরপর আল্লাহ তা’আলা যাকে চান রাজত্ব দান করবেন। সুনানে আবু দাউদ, কিতাবুস্সুন্নাহ, বাব ফিল খুলাফা : ৪৬৪৬ ইহার সনদ হাসান এই হাদীসটি ইমাম তিরমিযী হাসান :২২২৬, ইবনে হিব্বান আল ইহসান: ৬৯৪৩-৬৯০৪ এবং আহমদ ইবনে হাম্বল রহঃ আস্সুন্নাত লিল খিলাল: ৬৩৬ কিতাবে সহীহ বলেছেন।
এই হাদীসের বর্ণনাকারী সাফিনা রা. তাঁর ছাত্রদের খুলাফায়ে রাশেদীনের সংখ্যা  ও কাল এভাবে বর্ণনা করেছেন:
(১) আবু বকর রা. দু’ বছর (২) ওমর রা. দশ বছর (৩) ওসমান রা. বার বছর  এবং (৪) আলী রা. ছয় বছর।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেন, খেলাফতের ব্যাপারে হযরত সাফিনা রা. -এর হাদীস সহীহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের ব্যাপারে আমি উল্লেখিত হাদীসের সমর্থক।  জামে বয়ানুল ইলম ওয়া ফাজলুহু: ৬/২২৫, আল-হাদীস: ৮/১২
হযরত ইরবায বিন সারিয়া রা. হতে বর্ণিত-
‘একদিন রাসূল সা. আমাদের নামায পড়িয়ে আমাদের দিকে মুখ করে সাবলিল, সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক অর্থবহ ওয়াজ করলেন, যার দরুন আমাদের অন্তর-হৃদয় কেঁেদ উঠল, চক্ষু হতে পানি ঝড়তে লাগল। কেহ জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটাতো বিদায় দানকারীর ওয়াজ। হে রাসূল সা.! আপনি আমাদের  থেকে কি অঙ্গিকার নিতে চান? নবী করীম সা. বলেন, আমি তোমাদেরকে অসীয়ত করতেছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে আর আমীরের আনুগত্য করবে, যদিও তিনি হাবশী গোলাম হন। কেননা আমার পরে যারা জীবিত থাকবে তারা অনেক বিভেদ/মতপার্থক্য দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত শক্ত করে আকড়ে ধরে রাখবে, এবং নতুন নতুন জিনিস  থেকে বেচে থাকবে। কেননা, (দ্বীনের ব্যাপারে) সমস্ত নতুন আবিস্কার বিদ’আত আর প্রত্যেক বিদ’আতই পথভ্রষ্টতা। সুনাননে আবু দাউদ ৪৬০৭ ইহার সনদ সহীহ। ইহাকে ইমাম তিরমিযী (তিরমিযী:২৬৭৬), ইবনে হিব্বান (মাওয়ারিদ:১০২), হাকেম (মুসতাদরাক:১/৯৫-৯৬) এবং ইমাম যাহাবী রহ. সহীহ বলেছেন।
উল্লেখিত সহীহ হাদীসে যে সমস্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত শক্ত করে ধরে রাখার কথা বলেছেন , তা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো হযরত আবু বকর রা. হযরত ওমর রা. হযরত ওসমান রা. এবং হযরত আলী রা.। ওনাদের মধ্যে প্রথম দু’জন নবী করীম সা. -এর শশুড় ছিলেন এবং বাকী দু’জন নবী করীম সা. -এর জামাতা। প্রথম দু’জন খোলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে হযরত আবু বকর রা. ছিলেন সর্ব প্রথম ঈমান আনয়নকারী এবং নবীর সা. পরে উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি। তারপর হযরত ওমর রা. এর মর্তবা। দ্বিতীয় দু’জন খলীফার মধ্যে হযরত ওসমান রা. হুযূর সা. -এর পর পর দুইজন কন্যাসন্তানের জামাতা ছিলেন। এবং হযরত আলী রা. হযরত ফাতেমা রা.-এর স্বামী ছিলেন।
আবুল হাসান আল-আশআরী (মৃত্যু:৩২৪) বলেন- ‘আমাদের নীতি/মাযহাব হলো, চারজন খলিফা (হযর আবু বকর, ওমর, ওসমান ও আলী রা. খোলাফায়ে রাশেদীন। তাঁরা উম্মতের অন্য সকলের চেয়ে উত্তম ছিলেন এবং অন্য কেউ ফযীলতের দিক থেকে তাদের বরাবর হবে না।  (আল-ইবানা আল উসূলিদ দিয়ানাহ পৃষ্ঠা ৬০, দ্বিতীয় সংস্করণ পৃষ্ঠা ১১)
আবু জাফর তাহাবী রহ. (মৃত্যু:৩২১হিঃ) তাঁর কিতাব ‘আক্বিদাতুত্তাহাবীতে’ উল্লেখিত চারজনকে খোলাফায়ে রাশেদীন আখ্যা দিয়েছেন। (শরহে আক্বিদাতুত্ তাহাবী, শাইখ আলবানী’র তাহকীক কৃত পৃষ্ঠা ৫৩৩-৫৪৮)
সকল মুসলমানের এটা আবশ্যক যে, তারা খোলাফায়ে রাশেদীন এবং সমস্ত সাহাবায়ে কেরামদেরকে ভালবাসবে।

Related posts

Leave a Comment