নামাযের শুদ্ধরূপ এবং প্রচলিত ভুলসমূহ

মাওলানা আবদুস সাত্তার আইনী :
মানব ও জিন জাতিকে আল্লাহপাক তাঁর ইবাদতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। এই ঘোষণা আল্লাহপাক কুরআনেই দিয়েছেন এবং মানুষ যেনো শুদ্ধ ও সুষ্ঠুভাবে ইবাদত শিখতে পারে এবং পালন করতে পারে সেজন্য তিনি যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তিনি মানুষকে প্রদান করেছেন পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই জীবনব্যবস্থার নাম ইসলাম। ইসলাম পাঁচটি মৌলিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ঈমান, নামায, রোযা, হজ ও যাকাত ইসলামের মূল ভিত্তি। দেখা যাচ্ছে ঈমানের পরেই নামাযের স্থান। রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই ব্যয় করেছেন মানুষের শিক্ষা-দীক্ষার কাজে এবং তিনি ছিলেন মহান শিক্ষক। তিনি সরাসরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যেসব বিষয় শিখিয়েছেন সেগুলোর অন্যতম নামায।
রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে সাহাবিদেরকে নামায শিখিয়েছিলেন, তিনি তাঁদেরকে নামাযের যে-সুষ্ঠুরূপ শিক্ষা দিয়েছিলেন তাতে বর্তমান সময়ে অনেক ভুল যুক্ত হয়েছে। এই ভুলের চর্চা হচ্ছে প্রধানত না জানার কারণে এবং দ্বিতীয়ত ভুলভাবে নামায শেখা ও শেখানোর কারণে; সহি-শুদ্ধভাবে দীন-চর্চার অনাগ্রহও অনেকাংশে দায়ি। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা নামাযের সুষ্ঠুরূপ আলোচনা এবং নামাযের ব্যাপারে প্রচলিত ভুলগুলো পর্যালোচনা করার প্রয়াস পাবো।
নামাযের ধারাবাহিক কর্যাবলি এবং সেগুলোতে প্রচলিত ভুলসমূহ পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো।

নিয়ত :
নামাযের প্রথম কাজ হলো নিয়ত করা, অর্থাৎ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে নামায আদায় করার সংকল্প করা তথা কোন্ নামাজ পড়তে যাচ্ছে তার চুড়ান্ত মানসিক সিদ্ধান্ত নেয়া। যেহেতু নিয়ত মানে অন্তরের সংকল্প বা সিদ্ধান্ত এবং তা অন্তরের সঙ্গেই সম্পৃক্ত, সুতরাং নামাযের নিয়তের জন্য মুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয়। অন্তরের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত ব্যতীত শুধু মুখের উচ্চারণের মাধ্যমে নিয়ত হয় না। নিয়ত আরবিতে করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নিয়ত অন্তরের সংকল্প ছাড়া কিছু নয় বলে এখানে আরবি বা বাংলার প্রশ্ন ওঠে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুধু মুখে উচ্চারণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না; তবে মনের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাথে সাথে মুখে উচ্চারণ নাযায়িজ নয়।প্রচলিত ভুল :
নিয়তের ক্ষেত্রে আমরা যে-ভুল করে থাকি তা হলো, আমরা মনে করি নিয়ত আরবিতে করতে হবে এবং তা মুখে উচ্চারণ করতেই হবে। ফলে অনেকেরই মুখে উচ্চরণ করতে করতে তাকবিরে-উলা ছুটে যায়। জানাযার নামাযের ক্ষেত্রেও এই ভুল প্রচলিত।
কিয়াম :
কিয়াম অর্থ দাঁড়ানো। কিয়াম অবস্থায় উভয় পায়ের মাঝে চার আঙ্গুল পরিমাণ, ঊর্ধ্বে এক বিঘত পরিমাণ ফাঁক রাখা এবং পায়ের আগাগোড়া সম্পূর্ণ সোজা রাখা জরুরি।[১] ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামায শুরু করতে হবে এবং উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠাতে হবে। হাত উঠানোর সময় মাথা না ঝুঁকিয়ে কেবলামুখি হয়ে সেজদার জায়গায় দৃষ্টি রাখতে হবে। উভয় হাতের তালু কেবলামুখি করে হাতের আঙ্গুলগুলো স্বাভাবিকভাবে রাখতে হবে।[২]
সতর্কতা :
তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, মুসল্লির তাকবিরে তাহরিমা যেনো ইমামের তাকবিরে তাহরিমার আগে না হয়। এরকম হলে মুসল্লির নামাযই হবে না।[৩]  তাকবির বলার পর হাত বাঁধার সময় ডান হাতের তালু বাম হাতের পিঠের ওপর রাখতে হবে।[৪]  ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ও কনিষ্ঠাঙ্গুল দ্বারা গোলাকার বৃত্ত বানিয়ে বাম হাতের কব্জি ধরতে হবে।[৫] হাত বাঁধার পর সানা পড়তে হবে।[৬]
 প্রচলিত ভুল :
আমরা অনেকেই হাত উঠানোর সময় মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দিই এবং তাকবিরে তাহরিমা বলার সময় চাদরের ভেতর থেকে হাত বের করি না। ফলে কান পর্যন্ত হাত উঠানো সম্ভব হয় না। অনেকে হাতের তালু কেবলামুখি করে উঠান না। বরং হাতের তালু কানমুখি করে দু’পাশে হাত তুলে অথবা দুই কান ধরে নিয়ত করেন। অনেকে তাকবির বলতে দেরি করে ফলে তার তাকবিরে-উলা ছুটে যায়। (তাকবিরে-উলা ছুটে যাওয়ার অর্থ হলো ইমামের তাকবিরের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তাদির তাকবির না বলা এবং ইমামের কেরাত শুরু করার পর মুক্তাদির তাকবির বলা।) কোনো কোনো ইমাম তাকবির বলার সময় ‘আল্লাহু’ শব্দের ‘আলিফ’ ও ‘লাম’ বেশি লম্বা করেন ফলে ইমামের তাকবিরের পূর্বেই মুক্তাদি তাকবিরে তাহরিমা বলে ফেলে। কেউ কেউ তাকবির বলার পর দুই হাত নিচের দিকে ঝুলিয়ে তারপর হাত বাঁধেন। অনেকে দাঁড়ানোর সময় পায়ের সম্মুখ ভাগ উত্তর-দক্ষিণ দিকে তেছড়া করে রাখেন, ফলে দুই পায়ের মাঝে সমান ফাঁক থাকে না। অনেকে দাঁড়ানোর সময় মাথা ঝুঁকিয়ে রাখেন। এসব ভুল পরিহার করা অপিহার্য।

কিরাত :
কিরাতের সুন্নত পদ্ধতি হলো, ছানা পড়ার পর চুপে চুপে পুরো আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পড়া।[৭]  এরপর চুপে কিরাতওয়ালা নামাযে চুপে এবং অন্য নামাযে উচ্চঃস্বরে সূরা ফাতিহা পড়া। সূরা ফাতিহা শেষ হওয়ার পর নামায জামাতে হলে ইমাম ও মুক্তাদি উভয়ে আমিন বলা। এটা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।[৮]
ফাতিহার পর প্রথম দুই রাকাতে সূরা মেলানো এবং তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতে শুধু ফাতিহা পড়া। জামাতে নামাযের সময় শুধু ইমাম সাহেব কিরাত পড়বেন এবং মুক্তাদিগণ চুপচাপ তা শ্রবণ করবেন।*  ফরয নামাযের কিরাতের ক্ষেত্রে ফজর ও যোহরের নামাযে ‘তিওয়ালে মুফাস্সাল’ (সূরা হুজুরাত থেকে সূরা বুরুজ), আসর ও এশার নামাযে ‘আসওয়াতে মুফাস্সাল’ (সূরা আত তারিক থেকে সূরা লাম-ইয়াকুন) এবং মাগরিবের নামাযে ‘কিসারে মুফাস্সাল’ (সূরা যিলযাল থেকে সূরা নাস) থেকে পাঠ করা। এর যেকোনো একটি সূরা বা সে-পরিমাণ পাঠ করা। [৯] কিরাতের ক্ষেত্রে ফজরের প্রথম রাকাত দ্বিতীয় রাকাত অপেক্ষা দীর্ঘ করা। অন্যান্য নামাযে উভয় রাকাতে কিরাত সমান রাখা। সুন্নত ও নফল নামাযের প্রত্যেক রাকাতে কিরাত পড়া এবং প্রত্যেক রাকাত সমপরিমাণ রাখা।
প্রচলিত ভুল :
অনেকে মনে করেন, আস্তে কিরাত পড়ার সময় মদ্দ, গুন্নাহ, ইযহার, ইখফা ইত্যাদি ঠিক রাখা জরুরি না। এ ধারণা ঠিক নয়। এগুলো অবশ্যই পালন করতে হবে। অনেকে যোহরের নামাযে ‘তিওয়ালে মুফাস্সাল’ থেকে পড়া দূরের কথা, ‘আওসাতে মুফাস্সাল’ থেকেও পড়ে না। বরং ‘কিসারে মুফাস্সাল’ থেকে পড়ে। অনেকে এমন ধীর গতিতে পড়ে যে সুন্নত পরিমাণ কিরাত পড়া সম্ভব হয় না। আবার অনেকে এমন তাড়াতাড়ি করে পড়েন যে মুক্তাদি একটি হরফও বোঝে না এবং তা সুন্নত পরিমাণ থেকে অনেক বেশি হয়ে যায়। অথচ এতো ধীরে ধীরে বা এতো তাড়াতাড়ি কিরাত পড়তে নিষেধ করা হয়েছে।
রুকু :
কিরাত সমাপ্ত হলে কয়েক মুহুর্ত দেরি করে তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলা অবস্থায় রুকুতে যাওয়া। ইমাম জোরে এবং মুক্তাদি আস্তে তাকবির বলবেন। তারপর দুই হাত দ্বারা দুই হাঁটু ধরা এবং হাঁটু ধরার সময় হাতের আঙ্গুলগুলো ফাঁক রাখা। উভয় হাত সোজা রাখা, কনুই বাঁকা করে না রাখা এবং পাঁজর থেকে দূরে রাখা।[১০]  রুকু অবস্থায় পায়ের গোছা, হাঁটু ও উরু সম্পূর্ণ সোজা রাখা। মাথা, পিঠ ও কোমর বরাবর সোজা রাখা। রুকু অবস্থায় দৃষ্টি পায়ের দিকে রাখা এবং রুকুতে কমপক্ষে তিন তাসবিহ পরিমাণ দেরি করা এবং রুকুর তাসবিহ পড়া। ধীরস্থিরভাবে রুকু আদায় করে তাকবির বলা অবস্থায় রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানো। রুকুর তাকবিরে ইমাম ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদা’ এবং মুক্তাদি ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ পড়বেন এবং একাকী নামায আদায়কারী উভয়টি পড়বেন।[১১]
প্রচলিত ভুল :
রুকুতে যাওয়ার পর অধিকাংশ মুসল্লিই হাঁটু ধরার সময় আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে রাখে এবং হাত হাঁটুর ওপর হালকাভাবে রাখে, সোজা রাখে না। আবার রুকুতে গিয়ে মাথা-পিঠ-কোমর বরাবর সমান রাখে না। কেউ মাথা আর পিঠ উঁচু-নিচু করে রাখে আবার কেউ পিঠ গোল করে রাখে। এসব করা মাকরুহ। অনেকে হাঁটু সামনের দিকে বাঁকা রাখে বা পায়ের ওপরের অংশ পূর্ব দিকে বাঁকা রাখে। কেউ কেউ রুকুতে গিয়ে দেরি না করেই দাঁড়িয়ে যায়। আবার অনেকে রুকু থেকে সোজা হয়ে না দাঁড়িয়েই মাথা সামান্য উঠিয়েই সিজদায় চলে যায়। ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে দু’টি ওয়াজিবই তরক করা হয়। আর ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়াজিব তরক করা হলে নামাজ নষ্ট হয়ে যায়।
………………………………………………………………………
১. হেদায়া, ১য় খ-, পৃষ্ঠা-৭৩
২. জামেউত তিরমিযি, ১ম খ-, পৃষ্ঠা-৫৬; হেদায়া, ১ম খ-, পৃষ্ঠা-৭৩
৩.নুরুল ইযাহ, পৃষ্ঠা-৫০
৪.হেদায়া ১ম খ-, পৃষ্ঠা-৭৩
৫.মারাকিল ফালাহ, পৃষ্ঠা-৩০৮
৬.হেদায়া, ১য় খ-, পৃষ্ঠা-৭৩; ইলাউস সুনান, ২য় খ-, পৃষ্ঠা-১৭৯
৭.ইলাউস সুনান, ২য় খ-, পৃষ্ঠা-২৯
৮.মারাকিল ফালাহ, পৃষ্ঠা-২১১
৯.ইলাউস সুনান, ৪র্থ খ-, পৃষ্ঠা-৩১
১০. মুসলিম শরিফ, ১ম খ-, পৃষ্ঠা-১৬৯;
বুখারি শরিফ, ১ম খ-, পৃষ্ঠা-১০৯
১১.ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি, ১ম খ-, পৃষ্ঠ-১২
* এটা ইমাম আযম রহ. এর অভিমত, তবে ইমাম শাফী রহ. বলেন-সূরা ফাতেহা পড়তে হবে। ইমাম মালেক রহ. বলেন- ফজর, মাগরিব ও এশার নামাযে সূরা ফাতেহা না পড়া এবং যোহর ও আছরের নামাযে পড়াই উত্তম। হানাফীদের মধ্যে শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী রহ. ইহাকেই পছন্দ করিয়াছেন। তিনি ইহাকে একটি উত্তম মীমাংসা বলিয়া অভিহিত করেন। প্রমাণ: মেশকাত:২/২৮৩ হা.৭৯৪

Related posts

Leave a Comment