বাঙালি ভোজনরসিক। এদেশে বারো মাসে তেরো পার্বণের প্রধান একটি আকর্ষণ খাদ্য। এ খাদ্যের একটি কারি বা তরকারি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আজকের জেট সেট জমানার দুই বিশেষ উপাদান হারি বা ব্যস্ততা ও ওয়ারি কিংবা দুশ্চিন্তা। এই ত্রয়ীই আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী; অনুঘটক আপসেট বা পেটের পীড়ার। তবে কিছু সহজ উপায় এই বিড়ম্বনা থেকে আমাদের রেহাই দিতে পারে। এবার থাকছে এমন কিছু প্রয়োজনীয় টিপস।
আঁশযুক্ত খাবার
আঁশসমৃদ্ধ খাবার হজমের সহায়ক। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং শরীর সুস্থ রাখে। প্রতিদিন সুস্থ থাকার জন্য কমপক্ষে ২০-৩৫ গ্রাম এ-ধরনের খাবার খাওয়া প্রয়োজন। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোয়, রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা সামলাতে ও অর্শ রোগ বা পাইলস ঠেকাতে এটি সহায়তা করে। কুল, আপেল, আঙগুর, সীমের বীচি, বাদামজাতীয় খাবার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখলে আঁশযুক্ত খাবারের চাহিদা মিটবে।
চুইংগাম
চুইঙগাম চিবানোর ফলে আ্যসিড প্রশমনকারী থুথু তৈরী হয়, যা বুকের জ্বালাপোড়া কমাতে সহায়তা করে। তবে এটা করতে গিয়ে বাতাস গিলে ফেললে, পেট ফেঁপে যেতে পারে; এজন্য সতর্ক থাকতে হবে।
শারীরিক ওজন নিয়ন্ত্রণ
মাত্র দুই পাউণ্ড ওজন কমিয়ে পরিপাকতন্ত্রের রোগের লক্ষণগুলো দূর করা যায়। শরীরের মধ্যবর্তী অংশে অতিরিক্ত ওজনের কারনে হজমে সমস্যা হতে পারে। এটাই পরোক্ষে বুকজ্বালা ও গ্যাসের সমস্যা সৃষ্টি করে। তবে ওজন কমানোর কাজ শুরুর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরী।ভোজনে সংযত থাকুন
পরিমিত ভোজনের মধ্য দিয়ে হজমের সমস্যা, বুকজ্বালা প্রভৃতি প্রতিরোধ করতে পারেন। আরো বলে রাখি, ধীরে-ধীরে খেতে হবে। ক্ষুধার্ত হলেও দ্রুততা পরিহার করুন। এতে পরিপাকতন্ত্রের চাপ কম পড়বে এবং পাকস্থলির ধারণক্ষমতা সংকুচিত হবে। উপরন্তু কম খাবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে তা অপরমিতি ভোজনের অভ্যাস থেকে বিরত রাখবে।
প্রচুর তরল পানবেশি করে পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্ত থাকবেন। ফলের রসও পান করতে পারেন। পাশাপাশি পানির আধিক্য রয়েছে, যেমন – রসালো ফল, শসা ইত্যাদি খেতে পারেন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি পান করুন। তবে আপনার জন্য কতটুকু পানি প্রয়োজন, তা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন।
ব্যায়াম
শারীরিক ব্যায়াম হজমের ছোটখাটো অথচ অস্বস্তিকর সমস্যা যেমন- পেট ফাঁপা বা কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে সাহায্য করে। কায়িক শ্রম পরিপাকক্রিয়াকে সক্রিয় রাখে এবং শরীরের বর্জ্য নিষ্কাশনে সাহায্য করে। ফলে মানসিক চাপ ও হজমের অসুবিধা দূর হয়।
মানসিক চাপ, আলসার এবং কোষ্ঠকাঠিন্য
স্নায়ু-সমস্যায় স্টোমাক আপসেট হতে পারে; কারণ মস্তিষ্কের সঙ্গে হজমক্রিয়ার সরাসরি সম্পর্ক আছে। স্নায়ু চাপে হজমসমস্যা গুরুতর অসুখে পরিণত হয়। যেমন ইরিটেবল বাওয়েল সিণ্ড্রোম বা আরসার। শারীরিক পরিশ্রম, পর্যাপ্ত ঘুম, মেডিটেশন বা ধ্যান ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক চিন্তা দূর করা যায়।
সঠিক খাবার নির্বাচনসেই সব খাবার খাওয়া কমিয়ে দিন বা বন্ধ রাখুন, যা হজমে ব্যাঘাত ঘটায়। কারো-কারো গ্যাস উৎপাদনকারী সীম জাতীয় খাবার বা সোডা, ভাজাপোড়া খাবার বা পনির, আবার কারো কারো জন্য অম্ল উৎপাদনকারী লেবু, কফি, চা, টমেটো ইত্যাদি খাবার অন্ত্রে সমস্যা তৈরী করতে পারে।
ধুমপান বর্জন করুন
ধুমপান হজমে নানা সমস্যা হয়। খাদ্যনালির নিচের দিকে ভাল্ব দূর্বল হয়ে পাকস্থলির অ্যাসিডকে পিছন দিকে উল্টোপথে আসতে দেয়, যাতে বুকজ্বালা হয়। এ-কারণে অধুমপায়ীদের তুলনায় ধুমপায়ীদের পেপটিক আলসার ও ক্রনস ডিজিজের ঝুঁকি খুব বেশি।
বাড়তি লবণ এড়িয়ে চলুন
একটু বাড়তি লবণ খাবারে থাকলে তা পেট ফাঁপার কারণ হতে পারে। লবণদানি থেকে নেয়া বা প্যাকেটজাত খাবার মেশানো মাত্রাধিক লবণ থেকেও তা হতে পারে। কাজেই খাদ্যে লবনের পরিমাণ কমিয়ে ফেলুন ও প্যাকেটজাত খাবার কম খাওয়ার চেষ্টা করুন।
কিচেন সেফটি বজায় রাখুন
খাদ্যবাহিত অসুস্থতা মানেই ডায়রিয়া, বমি বা বমি-বমি ভাব। এর হাত থেকে বাঁচতে চাইলে ঠান্ডা খাবার ঠান্ডা এবং গরম খাবার গরুম রাখুন। কাঁচা ফল, শাক-সবজি, কাঁটা মাংস, পোল্ট্রিজাত মুরগি, সামুদ্রিক মাছ এসব কাটতে ও রান্নার প্রস্তুতির জন্য কিচেনে আলাদা ছুরি ও কাটিং বোর্ড ব্যবহার করুন। এছাড়া খাবারে ব্যবহৃত দুধ অবশ্যই হতে হবে পাস্তুরিত।
দুগ্ধজাত খাবার যখন সমস্যা
দুগদ্ধজাত খাবারের স্বাভাবিক শর্করা (যাকে ল্যাকটোজ বলে) অনেকেরই হজম হয় না। ফলে দুধ বা দুধ থেকে তৈরি খাবার খেলেই পেট ফেঁপে যায় এবং গ্যাস তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে দুধ, পনির, আইসক্রিম ও অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলুন। পরিবর্তে ল্যাকটোজ বর্জিত খাদ্য, যেমন সয়া-প্রোটিন দিয়ে তৈরী খাবার খেতে পারেন।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেনপেটের সমস্যার জন্য আপনার দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হলে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। গিলতে সমস্যা হলে, গলায় আটকে যাওয়া ভাব হলে, লালচে বা কালো রঙের বমি বা মলত্যাগে, পেটে ব্যথা কিংবা ওজন কমে গেলে অবিলম্বে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। পেটের গোলমালের কারণ হিসাবে ফুড পয়জনিং থেকে শুরু করে পিত্তথলিতে পাথর, ক্রনস ডিজিজ, আলসার, ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম বা ডাইভারটিকুলাইটিস জাতীয় মারাত্মক রোগ ও সনাক্ত হতে পারে। সমাপ্ত