জ্ঞান ভাণ্ডার ::::: মে – ’১২

জগত

সম্পর্কে

জ্ঞান

 

 

 

জরিপ নির্বাচন

 

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নগরী ভিয়েনা

 

নিঃসন্দেহে ধর্মীয় ঐতিহ্যে ও বরকতময় হিসেবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর হচ্ছে পবিত্র মক্কা মুকাররমা, অতঃপর পবিত্র মদীনা মুনাও্ওয়ারা, তারপর পবিত্র মসজিদে আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকা। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।

তবে পার্থিব বিশেষণে শ্রেষ্ঠ নগরী হিসেবে জরিপে নির্বাচিত হয়েছে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা। পৃথিবী বিখ্যাত লিভিং স্ট্যান্ডার্ড নির্ণায়ক প্রতিষ্ঠান মার্সার পৃথিবীতে বসবাসের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর কোনটি – সেটি জানতে বিশ্বজুড়ে সম্প্রতি একটি জরিপ চালায়। এ জরিপে পৃথিবীতে বসবাসের জন্য শ্রেষ্ঠ নগরী নির্বাচিত হয়েছে ভিয়েনা।

সারাবিশ্বের প্রায় আড়াইশ’র মতো শহরের অবকাঠামো, সড়ক নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর জরিপ চালিয়ে এ তথ্য প্রকাশ করেছে মার্সার। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এ তালিকার ২০৪ নম্বরে অবস্থান করছে। আর বাগদাদ রয়েছে সর্বনিম্ন অবস্থানে।

তালিকার শীর্ষ ১০ নগরীর সব ক’টিই জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের শহর। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে জার্মানির মিউনিখ, ডুসেলডর্ফ ও কানাডার ভ্যাঙ্কুভার। সপ্তম, অষ্টম ও নবম স্থানে রয়েছে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা ও বার্ন। দশম স্থানে রয়েছে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন।

শীর্ষ ২০ শহরের মধ্যে রয়েছে অকল্যান্ড, সিডনি, ওয়েলিংটন, মেলবোর্ন ও পার্থ। আর এশিয়ার সেরা শহরের মর্যাদা পেয়েছে সিঙ্গাপুর।

জরিপে বলা হয়েছে, ভিয়েনার সুসজ্জিত ভবন, পার্ক ও সাইকেলের প্রভূত ব্যবহার শহরে প্রতিদিনের পরিবহনের খরচ সম্প্রতি ১ ইউরোতে নিয়ে এসেছে। ১ কোটি ৭০ লাখ বাসিন্দার এ শহরে গুরুতর অপরাধের ঘটনা বিরল। ভিয়েনা লোয়ার অস্ট্রিয়া প্রদেশের ৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট, সুন্দর, ছবির মতো সাজানো-গোছানো একটি শহর।

খৃস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীতে ভিয়েনার গোড়াপত্তন হয়। তবে ভিয়েনার আধুনিক নগর যাত্রার শুরু ৯৫৫ খৃস্টাব্দে। এর বয়স ১০০০ বছরের বেশী হলেও এখনও এটি যেন চিরনতুন এক শহর। ভিয়েনা মোট ২৩টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। একেকটি প্রশাসনিক অঞ্চল বাংলাদেশের একেকটি ইউনিয়ন পরিষদের মতো পরিসরের অথবা কোন কোনটি এর চেয়েও ছোট। এ প্রশাসনিক অঞ্চলগুলো ঠিক এমনভাবে গঠন করা হয়েছে, যেন যে কোন সমস্যায় ৫ মিনিটের ভেতর পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড অথবা জরুরী বিভাগে কর্মরত ডাক্তাররা ওই এলাকায় যেতে পারেন। শুধু ভিয়েনা নয়, পুরো অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক ধরনটা ঠিক এরকম।

প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলের কাউন্সিলর ও ভিয়েনার মেয়র জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও কার্যত ভিয়েনার পুরো প্রশাসন পরিচালনা করেন প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলের সরকার নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটরা। প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলে ঠিক কতজন লোক বাস করছে, তার সঠিক হিসাব এসব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রয়েছে। ভিয়েনায় রয়েছে রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা। ফলে কেউ বাসা পরিবর্তন, অন্য প্রদেশে বসবাস অথবা দেশান্তর হতে চাইলে ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতেই হবে। উদাহরণস্বরূপ, কারো ছেলের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় হলে ম্যাজিস্ট্রেটরাই চিঠি দিয়ে জানাবেন, তিনি প্রশাসনিক অঞ্চলের কোন্ বিদ্যালয়ে তার ছেলে বা মেয়েকে ভর্তি করাবেন।

প্রসঙ্গত বলা দরকার, আমাদের বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেনের মতো নয় ওখানকার কিন্ডারগার্টেনগুলো। ভিয়েনার সব কিন্ডারগার্টেন সরকারী। বেসরকারী কোন কিন্ডারগার্টেন নেই সেখানে। সকাল ৭টা থেকেই বাবা-মায়েরা সন্তানদেরকে কিন্ডারগার্টেনে রেখে আসেন। প্রতি ৮ বা ১০জনের একেকটি শিশুদলের পরিচর্যার জন্য কিন্ডারগার্টেনে রয়েছেন ফুফু অথবা খালাম্মারা। কিন্ডারগার্টেনে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে কোন শব্দ নেই। বাবা-মায়ের মতোই খুব যতœ ও আদরে সেখানে আনন্দের সাথে শিক্ষাদান করা হয়।

কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের ইচ্ছামাফিক খাবার ও পানীয় সরকার সরবরাহ করে বিনামূল্যে। সেখানে শিশুদের শৃংখলা শেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। একটু বড় হলে ওসব শিশুকে নেয়া হয় রাস্তায় ট্রাফিক লাইটের সংকেত চেনানো, শিশুতোষ পাঠ বাস্তবে দেখানো এবং রাস্তাঘাটে উচ্চস্বরে কথা বলা অভদ্রতা  – এসব শেখানোর জন্য। ভিয়েনাতে শিশুরা কিন্ডারগার্টেন এত উপভোগ করে যে, সেখান থেকে ফিরে না আসার জন্য অনেক ছেলেমেয়েকে কান্নাকাটি করতে দেখেছি। এভাবে কিন্ডারগার্টেন থেকে প্রাইমারী স্কুল হয়ে হাইস্কুল পর্যন্ত শিশুদের পড়াশোনার বিষয় মা-বাবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটরাই অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করেন।

এবার আসি যোগাযোগ ব্যবস্থার কথায়। যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভিয়েনা বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধন করেছে। ভিয়েনায় চলাচলকারী বাস, ট্রেন, ট্রাম ও আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো রেল সবই সরকারী। ৩০ ইউরো দিয়ে একেকটি যাতায়াত কার্ড কেনার পর নগরবাসীরা সারামাস ধরে ভিয়েনার যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাতায়াত করতে পারেন। ভিয়েনার যে কোন প্রান্তে যাতায়াতের জন্য প্রতি ৫ মিনিট পর পর বাস, ট্রেন, ট্রাম ও মেট্রোর ব্যবস্থা রয়েছে। বাস, ট্রেন, ট্রাম ও মেট্রোয় সাধারণত টিকিট চেকিং হয় না। যাত্রীরা নিজ দায়িত্বেই টিকিট কেটে থাকেন। ভিয়েনায় রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড-১, আন্ডারগ্রাউন্ড-২ ও আন্ডারগ্রাউন্ড-৩ মেট্রো রেল, যা পুরো শহরকে অতি অল্প সময়ে যানজটহীন যাতায়াতের এক শ্রেষ্ঠ শহরে পরিণত করেছে।

এবার আসি নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথায়। অস্ট্রিয়ায় গুরুতর অপরাধ অথবা খুনোখুনির ঘটনা একেবারেই বিরল বলা চলে। পুলিশ কঠোর হাতে এখানে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে। ভিয়েনার প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে একেকটি থানা। সেসব থানা কর্তৃক রয়েছে সার্বক্ষণিক টহলের ব্যবস্থা। রয়েছে ওয়াটার পুলিশ, যারা ভিয়েনার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত দানিয়ুব নদীতে টহল দিচ্ছে প্রতিদিন। রয়েছে আকাশ থেকে হেলিকপ্টারযোগে শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে নিরাপত্তা তল্লাশী। এ ছাড়া ভিয়েনার ওয়াটার পুলিশ কর্তৃক প্রতি সপ্তাহে একবার করে ডুবুরী দিয়ে দানিয়ুব নদীর তলদেশ তল্লাশীর ব্যবস্থা রয়েছে। ভিয়েনায় যে কোন ঘটনা-দুর্ঘটনায় পুলিশকে ৩ থেকে ৫ মিনিটের ভেতর হাজির হতেই হবে। দ্রুততম সময়ের ভেতর উপস্থিত হওয়ার জন্য প্রতিটি পাড়ায় একেকটি থানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৩ থেকে ৫ মিনিটের ভেতর হাজির হতে না পারলে রয়েছে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা। পুলিশের জন্য রয়েছে সার্বক্ষণিক মানসিক ডাক্তার, যাদের কাজ হচ্ছে পুলিশদের চাঙ্গা রাখাÑযাতে কোন ব্যর্থতায় অথবা অসফল অপারেশনের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে না যায়।

পুলিশ হচ্ছে অস্ট্রিয়ায় সবচেয়ে সম্মানিত চাকরী। স্কুল-কলেজগুলোতে শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েদের স্বপ্নের চাকরী হচ্ছে পুলিশ। গত বছর জনমত জরিপে জনবিশ্বাসের দিক থেকে অস্ট্রিয়ার পুলিশ ১ নম্বরে, বিচার বিভাগ ২ নম্বরে এবং রাজনীতিকরা ৩ নম্বরে স্থান পেয়েছেন। দায়িত্ব পালনকালে বিবদমান কোন পক্ষ থেকে অথবা বাইরের সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে এক গ্লাস পানি পান করাও পুলিশের জন্য দ-নীয় অপরাধ। চা, কফি অথবা টাকা-পয়সা নেয়া তো দূরের কথা। আইন এখানে গরীব-ধনী সবার জন্য সমান। দায়িত্ব পালন ছাড়াও পুলিশ তার অবসরে অথবা ছুটির সময়ে কারো কাছ থেকে কোন সুবিধা নিতে পারে না। পুলিশের কনস্টেবল থেকে অফিসার সবার বেতন ১৫০০ থেকে ২০০০ ইউরোতে বাঁধা। বেতনের বাইরে এক কানাকড়িরও প্রত্যাশা করতে পারে না পুলিশ এখানে।

ভিয়েনায় রয়েছে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা। প্রতিটি হাসপাতাল এখানে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে চলেছে রোগীদেরকে। ভিয়েনা তো বটেই, অস্ট্রিয়ার সব হাসপাতালেই রয়েছে সর্বাধুনিক হেলিকপ্টার অ্যাম্বুলেন্স। ভিয়েনার যে কোন স্থানে যে কোন ঘটনা-দুর্ঘটনায় ৫ মিনিটের ভেতর রোগীর কাছে ডাক্তারকে পৌঁছাতেই হবে। না হলে জরুরী বিভাগ ও দুর্ঘটনা বিভাগের ডাক্তার ও নার্সদের চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা রয়েছে।

ভিয়েনায় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অথবা ডায়াগনোসিসের জন্য ডাক্তারদেরকে কোন ফি দিতে হয় না জনগণকে। ফার্মেসী থেকেও ওষুধ কিনতে হয় না নিজের খরচে। রাষ্ট্রই এসবের বন্দোবস্ত করে। রাষ্ট্র এখানে স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করেছে।

যে কোন কারণেই হোক না কেন, ডাক্তাররা রোগীর অথবা রোগীর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা অসংযত আচরণ করতে পারে না, ব্যবস্থাপত্র দেয়ার আগে রোগীর কেস হিস্ট্রি শুনতে হয় ডাক্তারকে নিরুদ্বিগ্ন হয়ে। এমনকি ডাক্তারের চিকিৎসা-মান নিয়ে অসন্তুষ্ট রোগীকে জিজ্ঞেস করতে হয়, সে অন্য কোন ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে আগ্রহী কিনা। তাছাড়া সিরিয়াল দেয়া রোগীদের নির্ধারিত সময়ের ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বাইরে বসিয়ে রাখা হয় না।

ভিয়েনায় সাধারণত ডাক্তাররা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না। দু’-একজন করতে গেলেও রোগীরা ব্যবস্থাপত্র নেয় না ওসব ডাক্তারের। ফলে সরকারী চাকরিতেই ফিরে আসতে হয় ডাক্তারদের শেষ পর্যন্ত। একজন ডাক্তার তৈরী করতে সাধারণ মানুষের বিপুল অংকের করের টাকা ব্যয় হয় বলে ওখানকার ডাক্তাররা সনদ অর্জন শেষ করে সরকারী হাসপাতালগুলোতেই ফিরে আসে চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য।

আমাদের দেশের মতো কিনিক ব্যবস্থা ভিয়েনায় নেই। ধনী-গরীব সবার জন্যই সমান সুবিধা নিয়ে সদা উš§ুক্ত থাকে সরকারী হাসপাতালগুলো।

এছাড়া ভিয়েনায় নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে ফায়ার ব্রিগেড। সড়ক দুর্ঘটনা অথবা অগ্নিকা-স্থলে ৫ মিনিটের ভেতর ফায়ার ব্রিগেড কর্মীদের পৌঁছতে হবেই। না হলে রয়েছে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা। তবে ভিয়েনায় বাড়িঘরে সাধারণত আগুন লাগে না। কারণ, প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে ফায়ার ব্রিগেড এবং সেসব ফায়ার ব্রিগেডে রয়েছে প্রতিটি বাড়ী ও দোকানের নম্বরধারী অগ্নিনির্বাপন সফটওয়্যার। কোন বাসা বা বন্ধ দোকানে আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকলে ফায়ার ব্রিগেড স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানতে পারে ইলেকট্রনিক সংকেতের মাধ্যমে। জনগণকে ফোন করে ফায়ার ব্রিগেডে খবর দেয়ার কোন দরকার হয় না।

সব ক্ষেত্রেই এমন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে ভিয়েনায়, যা চোখে না দেখলে শুধু লেখা পড়ে আন্দাজ করা কঠিন। বিশেষভাবে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থাই ভিয়েনাকে আজ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভেতর শ্রেষ্ঠ শহরে পরিণত করেছে।

– শাহ নেওয়াজ বিপ্লব   

Related posts

Leave a Comment