সাময়িক নিবন্ধ ::::: মে – ’১২

ইসলামে শ্রম ও

শ্রমিকের মর্যাদা :

মে দিবসের প্রেক্ষিত

মুফতী শাঈখ মুহাম্মদ উছমান গনী

 

মে (May) হলো ইংরেজী বছরের পঞ্চম মাস। প্রাচীন গ্যাগরিয়ান ক্যালেন্ডারের তৃতীয় মাস। ১লা মে তারিখকে মে দিবস (May Day) বলা হয়। এটি ‘বিশ্ব শ্রমিক দিবস’ নামে খ্যাত। এর পিছনে রয়েছে এক জ্বলন্ত ইতিহাস।

১৮৫৬ সনে প্রথম অস্ট্রেলিয়াতে বঞ্চিত-নির্যাতিত-বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবীতে এবং মালিকদের অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নিপীড়ন বন্ধসহ বিভিন্ন দাবীতে শ্রমিক আন্দোলন শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৬ সনে এ আন্দোলন আমেরিকাতে দানা বাঁধে। সে বছর ৪ মে শিকাগোর হে-মার্কেটে মিছিলে বোমা বিস্ফোরণে একজন পুলিশসহ ৯ জন এবং পুলিশের গুলীতে আরো ৪ শ্রমিক নিহত হয়। তখন তীব্র আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের সেই দাবী মেনে নেয়া হয়। সেই সূত্রে ১৮৮৭ সনে আমেরিকার শ্রমিক সংগঠনগুলো ১লা মে শ্রমিক মুক্তি দিবস পালন করে।

১৮৯১ সন থেকে দিবসটি বিভিন্ন দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো পালন করতে শুরু করে। ১৯০৪ সনে জাতিসংঘ আই.এল.ও কনভেনশন (International labor Oriwented Convention)-এর মাধ্যমে এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সে  থেকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে মহান মে দিবস পালিত হচ্ছে মেহনতি মানুষের অধিকার আদায় ও বিজয়ের প্রতীক হিসেবে।

এ যাবত বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ৮০টি দেশ এ সনদে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু খোদ আমেরিকা আজো এ সনদে স্বাক্ষর করেনি (আন্তর্জাতিক পরিবেশ রক্ষা সনদেও আমেরিকা স্বাক্ষর করেনি)। এমনকি আমেরিকা ও কানাডা এ দিবসটি পালনও করে না; বরং তারা সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার জাতীয় শ্রমিক দিবস পালন করে থাকে। যে দেশগুলো আই.এল.ও. কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি, তাদের মধ্যে জাপান অন্যতম।

ইসলাম হলো ন্যায়ের ধর্ম, সাম্যের প্রতীক। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন – “তোমরা তাদেরকে তাদের নির্ধারিত মজুরী দিয়ে দাও।” (সূরাহ নিসা, আয়াত : ২৪)

বর্তমান বিশ্বে মজুরী নির্ধারণের ৩টি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে –

(ক) পুঁজিবাদী পদ্ধতি : শ্রমচাহিদা ও শ্রমিকের যোগান-এর ভিত্তিতে বেতন ধার্যকরণ এবং তাতে বৃদ্ধি ও সঙ্কোচন।

(খ) সমাজবাদী পদ্ধতি : শ্রমিকের সামর্থ অনুযায়ী কর্ম এবং তার প্রয়োজন অনুপাতে ভাতা প্রদান।

(গ) ইসলামী পদ্ধতি : শ্রমচাহিদা, অনুযায়ী শ্রমিকের যোগান, শ্রমিকের সামর্থ ও তার প্রয়োজন এবং জীবন যাত্রার মান, কাজের গুরুত্ব ও ধরণ, শ্রমিকের মেধা, দক্ষতা ও অংশিদারিত্ব বিবেচনায় পারিশ্রমিক নির্ধারণ।

জাহিলী যুগে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক ছিলো প্রভু-ভৃত্যের। তখন শ্রমিকের কোনো অধিকারই ছিল না। এমনকি তাদেরকে মানুষ বলেই গণ্য করা হতো না। শ্রমিকদেরকে পশুর মতো ক্রয়-বিক্রয় করা হতো এবং পণ্যের ন্যায় তাদের মালিকানার হস্তান্তরকরণ হতো। তাদের নিজেদের স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ছিল না। ইসলাম তাদের মানবিক অধিকারসহ সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করেছে। ইসলাম শ্রমিককে দিয়েছে ভাইয়ের অধিকার ও  অংশিদারিত্বের সম্মান।

ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা সম্পর্কে বহু নির্দেশনা রয়েছে। শ্রমের প্রতি উৎসাহ দিয়ে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে – “অতঃপর যখন নামায সম্পন্ন করা হবে, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর রিয্ক অন্বেষণ কর।” (সূরাহ জুমু‘আহ, আয়াত : ১০)

শ্রমের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন – “হালাল উপার্জন ফরজ ইবাদাতসমূহের পরের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ দায়িত্ব।” (তিরমিযী)।

অপর হাদীসে নবীজী (সা.) ইরশাদ করেন – “হালাল উপার্জনসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হলো – যা কায়িক শ্রম দ্বারা অর্জন করা হয়।” (মুসলিম)

শ্রমিকের অধিকার ও শ্রম গ্রহীতা মালিক পক্ষের কর্তব্য সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন – “শ্রমিকরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের দায়িত্বে অর্পণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা যার ভাইকে তার দায়িত্বে রেখেছেন, সে যা খাবে-তাকেও তা খাওয়াবে এবং সে যা পরিধান করবে, তাকেও তা পরিধান করাবে। আর তাকে এমন কষ্টের কাজ দিবে না, যা তার সাধ্যের বাইরে। অগত্যা কোনো কাজ কঠিন হলে, সে কাজে তাকে সাহায্য করবে।” (সহীহ-মুসলিম)

শ্রমিকের প্রতি দয়া প্রদর্শনে উৎসাহ প্রদান করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন – “কেউ তার শ্রমিকের কাজ সহজ করে দিলে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার হিসাব সহজ করে দিবেন।” (বুখারী)

শ্রমিকের পারিশ্রমিক ন্যায্যভাবে প্রদানের নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন – “তোমরা শ্রমিকের মজুরী পরিশোধ কর তার ঘাম শুকানোর আগেই।” (সুনান-বাইহাকী)

যারা শ্রমিকের মজুরী আদায়ে টালবাহানা করে, তাদেরকে মহানবী (সা.) সতর্ক ও সাবধান করে বলেন – “সামর্থবানদের পাওনা নিয়ে গড়িমসি করা জুলুম।” (সহীহ-বুখারী)

যারা কাজ করিয়ে শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করে না, তাদের ব্যাপারে ইসলামে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন – “কিয়ামতের দিন আমি তাদের বিরুদ্ধে থাকবো – যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে, মানুষকে বিক্রি করে এবং ওই ব্যক্তি যে কাউকে কাজে নিয়োগ করলো, তখন সে তার কাজ পুরা করলো, কিন্তু সে তার  ন্যায্য মজুরী দিল না।” (সহীহ-বুখারী)

আজ নানান জায়গায় শ্রমিক ও মালিকের বৈরী সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। এতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। ইসলামে শ্রমিক ও মালিকের সুসম্পর্কের প্রকৃষ্ট উদাহরণ সাহাবী হযরত আনাস (রা.)-এর কর্ম জীবন। তিনি একটানা ১০ বছর নবীজীর চাকরী করেছেন। তিনি বলেন – নবীজী (সা.) কখনো আমাকে বলেননি ‘এটা কেন করেছো? এটা কেন করোনি?’ আবার নবীজী (সা.) বলেন – “আনাস কখনো এমন কাজ করেনি – যাতে প্রশ্ন করা যায়।”

অপরদিকে ইসলাম শ্রমের গুরুত্ব দিয়েছে। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, “এক লোক এসে নবীজীর (সা.) কাছে ভিক্ষা চাইলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন – তোমার কি কিছুই নেই? তিনি বললেন, আমার একটি কম্বল আছে। নবীজী (সা.) বললেন – যান, কম্বলটি নিয়ে আসুন। তিনি কম্বল নিয়ে এলে নবীজী (সা.) তা নিলামে বিক্রয় করলেন দুই দিরহাম মূল্যে। এক দিরহাম তাকে দিয়ে দিলেন পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করতে এবং এক দিরহাম দিয়ে কুড়াল কিনে নবীজী (সা.) নিজ হাতে তাতে হাতল লাগিয়ে দিলেন। আর ওই লোকটাকে কাঠ কেটে উপার্জন করার নির্দেশ দিলেন।” (বুখারী ও মুসলিম)

ইসলামে শ্রমের মূল্যায়ন যথেষ্ট। সকল নবীগণই কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা  উপার্জন করেছেন। হযরত নুহ (আ.) কাঠমিস্ত্রী বা সূতারের কাজ করতেন। হযরত ইদরীস (আ.) সেলাই কাজ করতেন। নবী সুলাইমান (আ.)-এর পিতা নবী ও স¤্রাট হযরত দাউদ (আ.) লৌহশিল্প বা কামারের কাজ করতেন। নবী হযরত শু‘আইব (আ.)-এর খামারে হযরত মুসা ৮-১০ বছর চাকরী করেছেন। তেমনি আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত খাদীজার ব্যবসায় চাকরী করেছেন দীর্ঘকাল।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বোঝা গেল, শ্রমিকের যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি কর্তব্যও রয়েছে। অনুরূপ শ্রমগ্রহীতা বা মালিক তথা নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষের যেমন কর্তব্য রয়েছে, তেমনি তাদেরও রয়েছে অধিকার। সহজ কথায় : (১) শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক হবে ভাই-ভাই, (২) মালিক শ্রমিকের খাওয়া-পরা, আবাসনসহ মৌলিক চাহিদা পূরণ করবেন, (৩) শ্রমিকের কাজের সময় ও কাজ সহনীয় পর্যায়ে রাখবেন এবং (৪) শ্রমিক যেন তার কাজ সহজে করতে পারেন, সেজন্য কাজে সহযোগিতা ও অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখবেন।  এভাবে মালিক-শ্রমিক উভয়েই স্ব স্ব অধিকার লাভের পাশাপাশি কর্তব্য পালনেও যতœশীল হবেন। যাতে মালিক-শ্রমিক কারো দ্বারা কারো ক্ষতি না হয়।

ইসলামের বিধান মেনে সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করলে এবং অপরের হক আদায় করলে, সুষ্ঠু ও শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হবে। তখন আন্দোলন ও মিছিল-মিটিং ছাড়াই সকলে ন্যায্য পাওনা ও অধিকার লাভ করবেন।

 

 

Related posts

Leave a Comment