আল-কুরআনের আলো ::::: মে – ’১২

হযরত ঈসা (আ.)-এর জীবন :

উম্মতের জন্য শিক্ষা

 

শাইখুল হাদীস আল্লামা মুফতী মনসূরুল হক

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ঈসা (আ.)-এর জন্মের পরের পরিস্থিতি

মারয়াম (আ.) প্রসব বেদনা নিয়ে বাইতু লাহমে খেজুর বৃক্ষের নীচে আশ্রয় নেয়ার পর সেখানে হযরত ঈসা (আ.) জন্মলাভ করলেন। তিনি পিতৃ মাধ্যম ব্যতিরেকেই সতীত্বধারীণী কুমারী মায়ের বুক আলোকিত করে আগমন করলেন অলৌকিক মহামানবরূপে।

যখন হযরত ঈসা (আ.) বিনাপিতায় ভূমিষ্ট হলেন, তখন মারয়াম (আ.) সমাজের কথা চিন্তা করে নানাবিদ জল্পনা-কল্পনা ও পেরেশানীতে অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি এ অবস্থায় অস্থিরতার সাথে যা বলেন এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে –

“তিনি (মারয়াম) বললেন, হায়, আমি যদি এর পূর্বে মরে যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়ে যেতাম!” (সূরাহ মারয়াম, আয়াত : ২৪)

হযরত মারয়াম (আ.) কেন এ জাতীয় কথা বললেন, অথচ তিনি জানেন যে, তার সন্তান হচ্ছে বিশ্ববাসীর জন্য মহান আল্লাহর কুদরতী নিদর্শনÑযে ব্যাপারে তার কাছে জিবরাঈল (আ.) এসে জানিয়ে গিয়েছেন?

এ প্রশ্নের সমাধানে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহ.) তার তাফসীর গ্রন্থে কয়েকভাবে তার জবাব দিয়েছেন –

১। অতিকষ্টের সেই মুহূর্তে আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে থাকার বেদনা এবং সম্প্রদায়ের আশু অপবাদ রটানোর চিন্তায় তিনি বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে অনিচ্ছায় তাঁর যবান থেকে এ কথা বের হয়ে গিয়েছিল।

২। নিজের আনজাম চিন্তা করে এমন ধরনের কথাবার্তা বলা অস্বাভাবিক নয়। বুযুর্গানে দ্বীন থেকেও এ জাতীয় কথাবার্তা প্রমাণিত রয়েছে। যেমন, হযরত আবু বকর (রা.) একবার একটি পাখিকে গাছের ডালে দেখতে পেয়ে বললেন, “হে পাখি! তোমার জীবন কতই না সুখের ও আনন্দের, গাছের ডালে বসছ আর তার থেকে ফল খাচ্ছ! হায়! আমি যদি ফল হতামÑযা পাখি খেয়ে ফেলত!” হযরত উমর (রা.) একবার একটি মাটির টুকরো হাতে নিয়ে বললেন, “হায়! আমি যদি এ মাটির টুকরো হতাম! হায়! আমি যদি কিছুই না হতাম!” হযরত আলী (রা.) জঙ্গে জামালের দিন বলেছিলেন, “হায়! আমি যদি এ দিনের বিশবছর পূর্বে দুনিয়া হতে বিদায় নিয়ে যেতাম!” হযরত বেলাল (রা.) বলেছিলেন, “হায়! বেলালের মা যদি তাকে গর্ভে ধারণ না করতেন!” তাঁরা এসব বলেছিলেন আখিরাতের চিন্তায় বিভোর হয়ে।

বলা বাহুল্য, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর একদিকে বনী ইসরাঈলের অপবাদের ভয়, অপরদিকে নিদারুণ কাতরতার মুহূর্তে সেখানে কোনো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে তিনি দুশ্চিন্তার ঘোরে আবদ্ধ ছিলেন। এ বিষণœ অবস্থায় তিনি মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করে তা কামনা করেছিলেন।

এমন সময় নিম্নদেশ থেকে হযরত জিবরাঈল (আ.) সব ব্যাপারে কুদরতী সুবন্দোবস্তের সুসংবাদ জানিয়ে সান্ত্বনার বাণী শোনালেন। সেই সুসংবাদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন –

“অতঃপর নিম্নদিক থেকে ফেরেশতা তাকে আহ্বান করে বললেন, আপনি দুঃখ করবেন না, আপনার প্রতিপালক আপনার পাদদেশে একটি ঝর্ণা সৃষ্টি করেছেন। আর আপনি নিজের দিকে খেজুর গাছের কা- ধরে নাড়া দিন, তাতে তা আপনাকে সুপক্ক তাজা খেজুর দান করবে। সুতরাং আহার করুন, পান করুন এবং (সন্তানের প্রতি তাকিয়ে) চক্ষু শীতল করুন। অতঃপর যদি মানুষের মধ্যে কাউকে আপনি দেখেন, তবে তাকে বলে দিবেন, আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে (মৌনতা অবলম্বনের) সাওমের মানত করেছি। অতএব, আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সাথে কথা বলবো না।”

(সূরাহ মারয়াম, আয়াত : ২৪ – ২৬)

ফায়িদা : ইমাম কুরতুবী (রহ.) তার তাফসীর গ্রন্থে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় এ ঘটনা উল্লেখ করে বলেন –

১। কোনো কোনো আলেম বলেন, রিযিক যদিও নির্ধারিত, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা বনী আদমকে রিযিকের জন্য চেষ্টা-সাধনার দায়িত্ব দিয়েছেন। কেননা, এখানে মারয়াম (আ.) খেজুর গাছের কা- নাড়ানোর ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছেন। যেন তিনি আল্লাহর কুদরত দেখতে পারেন।

২। রিযিক অন্বেষণের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া এটা বান্দার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার হুকুম। তাই এটা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়।

৩। পূর্বে (নভেম্বরÑ’১১ সংখ্যায়) উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত মারয়াম (আ.)-এর নিকট বিভিন্ন সময় মহান আল্লাহর তরফ থেকে এমনিতেই নানারকম বে-মৌসুম ফল আসতো। অথচ এখানে তাঁকে কষ্ট করে ডাল টেনে ফল আহরণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ তারতম্যের হিকমত কী?

এ সম্পর্কে  উলামায়ে কিরাম বলেন, যখন মারয়ামের হৃদয় শুধুই মহান আল্লাহর জন্য ফারেগ ছিল, তখন তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে আল্লাহ তা‘আলা কষ্ট করা থেকে ফারেগ রেখেছিলেন। কিন্তু যখন ঈসা (আ.) ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মারয়াম (আ.)-এর অন্তর তার মুহাব্বতের সাথেও সম্পৃক্ত হলো এবং তিনি তার ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলেন, তখন তার উপর রিযিক অন্বেষণের দায়িত্ব অর্পিত হলো।

৪। রুবাই ইবনে খুসাইম (রহ.) বলেন, সন্তান প্রসবের পর মায়ের জন্য তরতাজা খেজুর ছাড়া উত্তম কোনো খাবার নেই। কেননা, এর চেয়ে উত্তম কোনো খাবার থাকলে আল্লাহ তা‘আলা মারয়াম (আ.)-এর জন্য তা আহারের ব্যবস্থা করতেন।

(তাফসীরে কাবীর, ১১ খণ্ড, ১০২ – ১০৩ পৃষ্ঠা/ সহীহ কাসাসুল কুরআন, ৪৬৭ পৃষ্ঠা)

বর্ণিত আছে, হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের পর সমস্ত মূর্তি তাঁর দিকে সিজদাবনত হয়। এ অবস্থা দেখে ইবলিস ঘাবড়ে যায়। সে নানাদিকে খোঁজ করে কোনো জিনিস দেখতে পেল নাÑপূর্বের দিকেও না, পশ্চিমের দিকেও না। তখন সে ব্যর্থ মনে ঘুরছিল। এমন সময় হঠাৎ দেখতে পেলÑএকটি খেজুর গাছের নীচে একজন মহিলা  একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছেন। আর ফেরেশতাগণ তাদেরকে বেষ্টন করে রেখেছেন এবং বলাবলি করছেন, একজন নবী পিতা ছাড়া জন্মলাভ করেছেন। এ কথা শুনে ইবলীস ঘাবড়ে গেল এবং মনে মনে বললো, নিশ্চয়ই এখানেই সেই ঘটনা ঘটেছে। অতঃপর ইবলীস কসম খেয়ে বললো, এর দ্বারা আমি অনেককে বিভ্রান্ত করবো। সেমতে পরবর্তীতে ইবলীস ইয়াহুদীদেরকে গোমরাহ করেছে এভাবে যে, ইয়াহুদীরা ঈসা (আ.)কে নাউজুবিল্লাহ জারজ সন্তান বলে অস্বীকার করেছে। আর খৃস্টানদেরকে ভ্রষ্ট করেছে এভাবে যে, তারা বলেছে, ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র।

অপরদিকে হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের অলৌকিকতা যে, ইবলিস বলতে লাগলো, প্রত্যেক মহিলাই গর্ভবতী হয়েছে আমার সামনে এবং সন্তান প্রসব করেছে আমার হাতের তালুতে। কিন্তু এ সন্তানের ব্যাপারে আমি জানি না। গর্ভের সময়েও নয় এবং প্রসবের সময়েও নয়। (দুররে মানসুর, ৫ম খ-, ৪৩৬ পৃষ্ঠা)

হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের পর ইবলীস তার ব্যাপারে অপপ্রচার করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য মারয়াম (আ.)-এর গর্ভে তার পিতা ছাড়া জন্ম লাভের সংবাদ সম্প্রদায়ের মাঝে ছড়িয়ে দিলো। এ সংবাদ শুনে বনী ইসরাঈল সম্প্রদায় মারয়ামকে খোঁজা আরম্ভ করলো। তারা তাঁকে খুঁজতে বাইতুল মুকাদ্দাসে গেলো। সেখানে তারা তার ব্যাপারে ইউসুফ নাজ্জারকে জিজ্ঞাসা করলÑযিনি মারয়ামের সাথে বাইতুল মুকাদ্দাসের খিদমত করতেন। তিনি উত্তর দিলেন, আমি জানি না। তবে তার কক্ষের চাবি হযরত যাকারিয়ার কাছে আছে। তারা যাকারিয়া (আ.) থেকে চাবি এনে দরজা খুললো এবং তাকে কক্ষে তালাশ করলো। সেখানে যখন তাঁকে পেলো না, তখন তারা ইউসুফকে অপবাদ দিল। এমন সময় এক ব্যক্তি বলল, আমি তাকে ওমুক জায়গায় দেখেছি। এ কথা শুনে তারা সেদিকে এগিয়ে গেল। (দুররে মানসুর, ৫ম খ-, ৪৩৭ পৃষ্ঠা)

অন্য এক বর্ণনায় আছে, মারয়াম (আ.) সুস্থতা অনুভব করলেন এবং বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসলেন। এদিকে তার সম্প্রদায় তার খোঁজে বের হয়ে একজন রাখালকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি ওমুককে দেখেছো? রাখাল বলল, না। তবে আমি একদিন রাত্রে আমার গরুর মধ্যে এমন একটি বিষয় দেখেছিÑযা পূর্বে কখনো দেখেনি। আমি দেখেছি যে, গরুটি এ উপত্যকার দিকে সিজদা করছে। তখন তারা সেদিকে এগিয়ে গেল। (দুররে মানসুর, ৫ম খ-, ৪৩৯ পৃষ্ঠা)

সেসময় মারয়াম (আ.) চল্লিশদিন পর নিফাস থেকে পবিত্র হয়ে গেলেন এবং সন্তানকে কোলে নিয়ে বের হয়ে আসলেন। পথিমধ্যে সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে তার দেখা হলো। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন –

“অতঃপর মারয়াম সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হলেন।”

(সূরাহ মারয়াম, আয়াত : ২৭)

সম্প্রদায়ের লোকেরা মারয়ামের কোলে বাচ্চা দেখে বিস্ময়ভরা বদনে এগিয়ে এলো এবং তাকে এ ব্যাপারে অপবাদ দিয়ে ভর্ৎসনা করতে লাগলো। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেনÑ

“তারা বলল, হে মারয়াম! তুমি তো এক অদ্ভুত কা- ঘটিয়েছো! হে হারূনের ভগ্নী! তোমার পিতা তো কোনো অসভ্য লোক ছিলেন না এবং তোমার মাতাও তো কোনো ব্যভিচারিণী ছিলেন না।”

(সূরাহ মারয়াম, আয়াত : ২৮)

এভাবে তারা হযরত মারয়ামের প্রতি মিথ্যা তুহমত আরোপ করলো। তারা মারয়াম (আ.)-এর পবিত্র ও নিষ্কলুষ চরিত্রকে কলুষিত করার জন্যে উঠে পড়ে লাগলো।

এ অবস্থায় মারয়াম (আ.) অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়লেন। তিনি নিজে কথাগুলো কাউকে বোঝাতে পারছেন না। কেননা, মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি আজ কোন মানুষের সাথে কথা না বলার সাওমের মান্নত করেছেন। আর নির্জনে গিয়ে তিনি যে আশ্রয় নিবেন, সে পরিস্থিতিও নেই। সবাই তাঁকে ঘিরে ধরেছে। তবে এ অবস্থায় তিনি বিচলিত হলেন না। ফেরেশতার বাণী পেয়ে আল্লাহর ওপর তাঁর তাওয়াক্কুল ও ভরসা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করে তাঁর পবিত্রতা সবার সামনে সুস্পষ্ট করে দিবেন। এ আত্মবিশ্বাস ও তাওয়াক্কুল নিয়ে তিনি প্রথমত ফেরেশতার বাতানো নির্দেশনা অনুযায়ী নিজের কথা না বলার রোযার মান্নতের কথা সম্প্রদায়ের লোকদেরকে ইশারায় বুঝালেন। এরপর  তিনি শিশু ঈসা (আ.)-এর দিকে হাত দ্বারা ইঙ্গিত করলেন। অর্থাৎ এ শিশুসন্তানের সাথে আপনারা কথা বলুন। এ সন্তানই আপনাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেবে। তখন বিবাদমনা লোকেরা বলল, আমরা তার সাথে কেমন করে কথা বলব? সে তো কোলের শিশু! তুমি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছ? এমন সময় দুধের শিশু ঈসা (আ.) অকষ্মাৎ কথা বলে উঠলেন এবং উদীপ্তকন্ঠে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিলেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন –

“তিনি (শিশু ঈসা) বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে তিনি নবী বানিয়েছেন। আর যেখানেই আমি থাকি না কেন, আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে যতদিন আমি জীবিত থাকি, ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর তিনি আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে বদনসীব করেননি। আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন আমি পূনরুত্থিত হবো।”

 

হযরত ঈসা (আ.)-এর কৈশোর

পবিত্র কুরআনে হযরত ঈসা (আ.)-এর শৈশবের কথাই শুধু বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর কৈশোরের কোনো ঘটনা কুরআন শরীফে আলোচিত হয় নি। তাই বিভিন্ন রিওয়ায়াতের আলোকে নিম্নে এ সম্পর্কে কিছু বিষয় উল্লেখ করা হলো।

ইসরাঈলী বর্ণনাসমূহের বিখ্যাত বর্ণনকারী ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ (রহ.) থেকে যে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এবং যার বর্ণনা মথির ইঞ্জীলেও আছে, সেখানে এ ঘটনাটিও রয়েছে যে, যখন হযরত ঈসা (আ.) ভূমিষ্ঠ হলেন, সে রাতে পারস্যের বাদশাহ আসমানে একটি অভিনব উজ্জ্বল নক্ষত্রের উদয় দেখতে পেলেন। বাদশাহ তার দরবারের জ্যোতিষী মণ্ডলীকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বললেন, এ নক্ষত্রের উদয় একজন মহামানবের জন্মলাভের সুসংবাদ বহন করে – যিনি শাম দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। তখন বাদশাহ স্বর্ণ ও মূল্যবান দ্রব্যসমূহের উপঢৌকন দিয়ে এক প্রতিনিধি দল শাম দেশে প্রেরণ করলেন। উদ্দেশ্য হলো, তারা সেখানে গমনপূর্বক সেই মর্যাদাশালী নবজাতক শিশুর জন্মগ্রহণ সম্পর্কিত যাবতীয় ঘটনা ও অবস্থাদি জেনে আসবেন।

এ প্রতিনিধি দল যখন শাম দেশে পৌঁছলেন, তখন তারা কাক্সিক্ষত অবস্থার অনুসন্ধান আরম্ভ করে দিলেন এবং ইয়াহুদীদেক বললেন, আমাদেরকে সে শিশুটির জন্মবৃত্তান্ত শুনান – যিনি অদূর ভবিষ্যতে রূহানী জগতের বাদশাহ হবেন। ইয়াহুদীরা পারস্যবাদীদের মুখে এ কথা শুনে নিজেদের বাদশাহ হিরোদিয়াসকে এ সম্পর্কিত সংবাদ প্রদান করল।

বাদশাহ হিরোদিয়াস পারস্য রাজ্যের প্রতিনিধি দলকে দরবারে ডেকে সংবাদটির সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তাদের মুখে ঘটনার বিবরণ শুনে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। অতঃপর প্রতিনিধি দলকে অনুমতি প্রদান করলেন যে, তারা যেন সেই শিশুটি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে অবগতি লাভ করেন।

পারস্যের প্রতিনিধি দল বাইতুল মুকাদ্দাসে পৌঁছার পর যখন ঈসা (আ.)কে দেখলেন, তখন তারা প্রথমে তাদের রীতিনীতি অনুযায়ী তাকে সিজদা করলেন। অতঃপর তাকে বিভিন্ন প্রকারের সুগন্ধি হাদিয়া দিলেন এবং কিছুদিন সেখানে অবস্থান করলেন।

সেখানে অবস্থানকালে প্রতিনিধি দলের কেউ স্বপ্নে দেখলেন যে,  তাকে বলা হচ্ছেÑহিরোদিয়াস বাদশাহ এ শিশুটির শক্র হবেন। অতএব, তোমরা তার কাছে না গিয়ে সরাসরি নিজ দেশে চলে যাও।

সকালে যাত্রাকালে প্রতিনিধি দল মারয়াম (আ.)কে বললেন, মনে হচ্ছেÑ বাদশাহ হিরোদিয়াসের অভিপ্রায় খারাপ এবং তিনি এ শিশুটির দুশমন হবেন। এ জন্যে উত্তম হবে যে, আপনি তাকে এমন স্থানে নিয়ে যান, যেখানে সে পৌঁছতে পারবে না।

এ পরামর্শ শুনে হযরত মারয়াম (আ.) শিশু ঈসাকে মিসরে নিয়ে গেলেন। যেখানে তার আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কেউ থাকতেন। পরে সেখান থেকে নাসেরায় চলে যান।

অতঃপর হযরত ঈসা (আ.)-এর বয়স যখন তের হলো, তখন মারয়াম (আ.) দ্বিতীয়বার তাকে নিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসেন। এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, হযরত ঈসা (আ.)-এর কৈশরের ঘটনাবলীও অসাধারণ ছিল।

(তারীখে ইবনে কাসীর, ২য় খণ্ড, ৭৭ পৃষ্ঠা/ ২/ কাসাসুল কুরআন, ৪র্থ খণ্ড, ৪৮ পৃষ্ঠা)

(ক্রমশ.)

 

Uncategorized

Related posts

Leave a Comment