ভূমিকম্প প্রতিরোধক বিল্ডিং ডিজাইন ও ভূমিকম্পের সময় করণীয়

ভূমিকম্প প্রতিরোধক বিল্ডিং ডিজাইন ও ভূমিকম্পের সময় করণীয়

নতুন বিল্ডিং বা কাঠামো নির্মাণ করার ক্ষেত্রে করণীয়:
১। যে কোন বিল্ডিং-এর নকশা তৈরি করার পূর্বেই স্ট্রাকচারাল নকশার বিধিগুলোর অনুসরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে সঠিক স্ট্রাকচারাল নকশা না হলে ভূমিকম্পরোধক বিল্ডিং হবে না।
২। বিল্ডিং ডিজাইনের আগেই অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা মাটির গুনাগুণ বিশ্লেষণ ও মাটির ধারণক্ষমতা নির্ভুলভাবে নির্ণয়পূর্বক রিপোর্ট তৈরি করতে হবে।
৩। বিল্ডিং নির্মাণের সময় অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের (সিভিল ইঞ্জিনিয়ার) তদারকি রাখতে হবে যাতে গুণগত মান ঠিক থাকে।
৪। সঠিক অনুপাতে গুনগতমানের সিমেন্ট, রড, বালির ব্যবহার হচ্ছে কিনা দেখতে হবে। কংক্রিটের চাপ বহন ক্ষমতা কোনো অবস্থাতেই ৩০০০ পিএসআই-এর নিচে নামানো যাবেনা । তার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে নির্মানাধীন সাইটে দায়িত্বে নিয়োজিত সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদেরকে কিউব অথবা সিলিন্ডার টেস্ট করতে হবে। কংক্রিটের মিক্সাচারে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। ঢালাই’র পরে পানির ব্যবহার করে কংক্রিটের কিউরিং করতে হবে।
৫। উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন রড পরীক্ষাপুর্বক ব্যবহার করতে হবে। রডের বহন ক্ষমতা ৬০ হাজার পিএসআই-এর কাছাকাছি থাকতে হবে। স্ক্র্যাপ বা গার্বেজ থেকে প্রস্তুতকৃত রড ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে ।
৬। বিল্ডিং-এর প্ল্যান ও এলিভেশান দুই দিকই সামাঞ্জ্য থাকতে হবে।
৭। নির্ধারিত ডিজাইনের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত ফ্লোর নির্মাণ করবেন না। বিল্ডিং কোড অনুসারে এক্সপানশান ফাঁক রাখতে হবে।
৮। বেশি পরিমান সরু ও উঁচু বিল্ডিং-এর পাশ হঠাৎ করে কমাবেন না। যদি কমাতে হয় তাহলে ত্রিমাত্রিক ডাইনামিক বিশ্লেষণ করে ডিজাইন করতে হবে।
৯। বিল্ডিং-এর উচ্চতা যদি ভবনের প্রস্থের ৪ (চার) গুণের অধিক হয় তাহলে ত্রিমাত্রিক ডাইমানশন বিশ্লেষণ করে ডিজাইন করতে হবে।
১০। ‘সেটব্যাক’ বা হঠাৎ করে বিল্ডিং-এর পাশের মাপঝোপ কমানো যাবেনা। যদি কমাতেই হয় তাহলে ত্রিমাত্রিক বিশ্লেষণ করে সাইট অ্যাফেক্ট জেনে ডিজাইন করতে হবে।
১১। জটিল কাঠামোগত প্লানের জন্য অবশ্যই ত্রিমাত্রিক ভূমিকম্প বিশ্লেষণ করে ডিজাইন করতে হবে।
১২। ‘শেয়ার ওয়াল’ বা কংক্রিটের দেয়াল সঠিক স্থানে বসিয়ে ভূমিকম্পরোধ শক্তির পরিমাণ বাড়াতে হবে।
১৩। সা¤প্রতিক সময়ে যে হারে ঋষধঃ চষধঃব ইঁরষফরহম ঝুংঃবস (বিম ছাড়া কলাম ও স্ল্যাব) বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে, তা মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প হলেই ধ্বসে যাবে। সুতরাং বিম, কলাম ও স্ল্যাব বিশিষ্ট বিল্ডিং তৈরি করতে হবে।
১৪। দায়িত্বরত ইঞ্জিনিয়ারকে “বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড” অনুসরণ করে বিল্ডিং-এর প্ল্যান/ ডিজাইন করে ভূমিকম্প রোধক বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে।
১৫। নিচের তলা পার্কিং-এর জন্য খালি রাখতে হলে, ঐ তলার পিলারগুলো বিশেষভাবে ডিজাইন করতে হবে। প্রয়োজনমতো কংক্রিটের দেওয়াল দিয়ে পিলারগুলোতে বেষ্টনীবদ্ধ করতে হবে।
১৬। বিল্ডিং-এর ‘বিমের’ থেকে ‘পিলারের’ শক্তি বেশি করে ডিজাইন করতে হবে। কমপক্ষে ২০% বেশি করতে হবে।
১৭। মাটির গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে যথাযথ ফাউন্ডেশন প্রকৌশলগতভাবে যাচাই বাছাই করে ডিজাইন করতে হবে।
১৮। ৫ ইঞ্চি ইটের দেয়ালগুলো ভূমিকম্পের জন্য আদৌ নিরাপদ নয়। তাই এই দেয়ালগুলো ছিদ্রযুক্ত ইটের ভিতরে চিকন রড দিয়ে আড়াআড়ি ও লম্বালম্বিভাবে তৈরি করে ‘লিন্টেলের’ সাথে যুক্ত করে দিতে হবে। সবদিকে ‘লিন্টেল’ দিতে হবে। বিশেষ করে দরজা বা জানালার খোলা জায়গায় চিকন রড দিয়ে ৫ ইঞ্চি ইটের দেয়াল যুক্ত করতে হবে।
১৯। মনে রাখতে হবে, নতুন বিল্ডিং নির্মাণে ভূমিকম্প-প্রতিরোধক নিয়মাবলি প্রয়োগ করলে, শুধুমাত্র ২-৩% নির্মাণ খরচ বৃদ্ধি পায়।
ভূমিকম্পের সময়ে করণীয়:
১। মানসিকভাবে শান্ত থাকুন ও অন্যদের শান্ত রাখুন।
২। বিল্ডিংটি বিম ও কলামের কাঠামোর ওপর নির্মিত হলে কলামের গা ঘেঁষে থাকুন। আর বিল্ডিংটি দেয়াল-নির্ভর হলে বাইরের কাছাকাছি কোনো কক্ষে অবস্থান নিন। যাতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেলেও উদ্ধার-কর্মীদের খুঁজে পেতে সুবিধা হয়।
৩। লিফট্ ব্যবহার করবেন না।
৪। বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে টর্চ ব্যবহার করুন।
৫। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হতে পারে, সজাগ থাকুন।
৬। মাথায় হেলমেট, কুশন বা বালিশ দিয়ে দরজার নিচে অথবা লোহার টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন।
৭। মাটির বাড়ি ও পরিত্যক্ত বিল্ডিং থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকুন।
ভূমিকম্পের সময় রাস্তায় থাকলে করণীয়:
১। খোলা জায়গায় অবস্থান নিন, শান্ত ও সচেতন থাকুন।
২। দৌড় দেবেন না।
৩। ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িঘর থেকে দূরে থাকুন।
৪। মাটির বাড়ি থেকে নিরাপদ জায়গায় চলে আসুন।
৫। পুরাতন বিল্ডিং থেকে দূরে থাকুন।
৬। বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকুন।
৭। ঢালু জায়গা বা দেয়াল থেকে দূরে থাকুন।
চলন্ত গাড়িতে থাকাকালীন সময়ে করণীয়:
১। চলন্ত গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখুন।
২। খোলা জায়গায় গিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে অবস্থান নিন।
৩। বৈদ্যুতিক তার থেকে গাড়িটি দূরে কোথাও পার্কিং করুন।
৪। দেয়ালের পাশে বা গাছের নিচে গাড়ি পার্কিং করবেন না।
৫। যদি খোলা জায়গা না থাকে, তাহলে গাড়ির গা ঘেঁষে বসে পড়–ন।
পরিশেষে সরকারি বেসরকারি বা ব্যক্তিমালিকানায় যেসব বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে তা পর্যবেক্ষনের জন্য সরকারের বিশেষ মনিটরিং সেল থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক বা অন্যকোন বিবেচনায় বহুতল ভবনের ডিজাইন অনুমোদন দেয়া যাবেনা। ডিজাইন অনুমোদনের পুর্বে প্রস্তাবিত স্হানের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও প্রকৌশল বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষন করে অনুমোদন দিতে হবে। সর্বোপরি দেশের মানুষকে ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেতন করে তোলতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্হানা মন্ত্রনালয়কে আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জামি ও যন্ত্রপাতি নির্ভর স্বয়ং সম্পুর্ণ মন্ত্রনালয় হিসেবে গড়ে তোলার সময় এসেছে। এবং সামনের বাজেটে যেন যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্যোগ মন্ত্রনালয়কে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হয় তার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ রইলো।

Related posts

Leave a Comment