মদীনা সনদঃ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভূতপূর্ব দলিল

ড.আ ফ ম খালিদ হোসেন
৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ইয়াহূদীদের মধ্যে সামাজিক ঐক্য ও রাজনৈতিক সমীকরণ, জাতীয় নিরাপত্তা, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার  মাধ্যমে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন যা ইতিহাসে ‘মদীনা সনদ’ (ঈযধৎঃবৎ ড়ভ গধফরহধয)  নামে পরিচিতি লাভ করে। এটাই ইতিহাসে লিখিত প্রথম সংবিধান। এর পূর্বে শাসকের মুখোচ্চারিত কথাই ছিল রাষ্ট্রীয় আইন। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এটাই ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের শাসননীতি। খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর পূর্বে মেসোপটেমিয়ার যেসব আইন বিধিবদ্ধ (ঈড়ফব ড়ভ ঐধসসঁৎধনর) করা হয় তা ছিল অসম্পূর্ণ এবং আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পক্ষান্তরে রসূলুল্লাহর সা. সংবিধান যুগোপযুগী ও প্রগতির পরিচায়ক। ৪৭টি ধারা সম্পন্ন এ সনদের প্রধান দিকগুলো হলোÑ
১. মদীনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদী, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায়সমূহ সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি সাধারণ জাতি (ঈড়সসড়হবিষঃয) গঠন করবে।
২. হযরত মুহাম্মদ (সা.) নব-গঠিত প্রজাতন্ত্রের সভাপতি হবেন এবং পদাধিকারবলে তিনি মদীনার সর্বোচ্চ বিচারালয়ের (ঈড়ঁৎঃ ড়ভ ধঢ়ঢ়বধষ) সর্বময় কর্তা হবেন।
৩. পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে; মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায় বিনা দ্বিধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে; কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৪. কেউ কুরায়শদের সাথে কোন প্রকার সন্ধি স্থাপন করতে পারবে না, কিংবা মদীনাবাসীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কুরায়শদের সাহায্য করতে পারবে না।
৫. স্বাক্ষরকারী কোন সম্প্রদায়কে বহিঃশত্রু আক্রমণ করলে সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা সমবেত প্রচেষ্টায় বহিঃশত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করবে।
৬. বহিঃশত্রুর আক্রমণে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ স্ব-স্ব যুদ্ধ-ব্যয়ভার বহন করবে।
৭. স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হবে; এর জন্য অপরাধীর সম্প্রদায়কে দোষী করা চলবে না।
৮. মদীনা শহরকে পবিত্র হিসেবে ঘোষণা করা হল এবং রক্তপাত, হত্যা, বলৎকার এবং অপরাপর অপরাধমূলক কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ করা হল।
৯. অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং সর্বপ্রকার পাপী বা অপরাধীকে ঘৃণার চোখে দেখতে হবে।
১০. ইহুদীদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।
১১. দুর্বল ও অসহায়কে সর্বতোভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
১২. মহানবী (সা.)-এর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত মদীনাবাসীগণ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
১৩. স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে হযরত (সা.) আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা দেবেন।
এই সনদের ফলে
প্রথমত: বহুধা বিভক্ত মদীনাবাসীদের গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়ে শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয়তঃ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইয়াহূদী নাগরিকের সমান অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কর্তব্যের সীমারেখা নির্ধারিত হয়।
তৃতীয়তঃ স্বদেশত্যাগী মুহাজিরীনদের  মদীনায় বাসস্থান ও জীবিকা  উপার্জনের ব্যবস্থা হয়।
চতুর্থতঃ  মুসলমান এবং অমুসলমানের মধ্যে মৈত্রী, সদ্ভাব ও পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠে।
পঞ্চমতঃ মদীনায় ইসলামের ধর্মীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক মতা বৃদ্ধি পেয়ে ধর্ম প্রচার ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। স্পষ্টতঃ এটা গোত্র ভিত্তিক আরববাসীদেরকে  ধর্ম ও রাজনীতির ভিত্তিতে  নতুন আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করে।
ষষ্ঠতঃ এই চুক্তি সম্পাদনকারী সব মানুষের জান-মাল ইজ্জতের নিরাপত্তার গ্যারান্টি প্রদান করা হয়।
সপ্তমতঃ বর্ণ-গোত্র-গোষ্ঠী, ভাষা ও আঞ্চলিকতার ঊর্ধে এক বিশ্বজনীন ভ্রাতৃ সমাজ, এক উম্মাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চুক্তির ফলে মদীনায় নগর রাষ্টের (ঈরঃু ঝঃধঃব) উদ্ভব হল এবং রাসূলুল্লাহকে সা. মুসলিম ও অমুসলিম উভয় পক্ষ হতে এই নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান স্বীকার করে নেয়া হল । রাসূলুল্লাহ সা. এর জন্য আন্তর্জাতিক সমাজ গঠনের পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল।
অষ্টমতঃ এই চুক্তির বলে রাসূলুল্লাহ সা. আইন, বিচার, প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনিক বিষয়সমুহ নিজের ও মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত করে দেন।
নবমতঃ এই চুক্তি অত্যাচার, বৈষম্য, অবিচার এবং এই প্রকৃতির অন্যান্য গর্হিত বিষয়গুলির দ্বার রুদ্ধ করে দেয়। আরববাসীদের ব্যক্তিগত ভাবে খুনের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রাচীন পদ্বতির পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে বিষয়টিকে একটি সম্মিলিত কর্তব্য রূপে সাব্যস্ত করা হয়।
দশমতঃ প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম মূর এর বক্তব্য অনুসারে এই চুক্তির কল্যাণে রাসূলুল্লাহ সা. একজন মহান পরিকল্পনাবিদ ও পরিচালকরূপে ধ্যান-ধারনা ও চিন্তা-চেতনায় বহুধা বিভক্ত, আদর্শ- বিশ্বাসে বিভিন্নমুখী ও পরস্পর হতে চরম বিচ্ছিন্ন একটি জনগোষ্ঠীকে সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ করার সুকঠিন কাজটি একজন শ্রেষ্ঠ ও বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের ন্যায় পরম দক্ষতার সঙ্গে সুচারুরূপে সম্পাদন করেন। রাসূলুল্লাহ সা. এমন একটি রাষ্ট্র এবং এমন একটি জনসমাজ প্রতিষ্ঠার সাফল্য অর্জন করেন, যা ছিল আন্তর্জাতিক রীতিনীতির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। ড.মুহাম্মদ হামীদুল্লাহ,আল-ওয়াছা’ইকুস সিয়াসিয়াহ ফিল আহ্দিন নববী,পৃ.১৫-২১; ইব্ন হিশাম,সীরাতুন্নবী,১খ,পৃ.৫৫৪-৫৬১
ইতিহাস প্রমাণ করে এই ঐতিহাসিক সনদ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদমান কলহ ও অন্তর্ঘাতের অবসান ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সম্প্রীতি, প্রগতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিবেশ সৃষ্টি করে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, গোত্রীয় দম্ভ, ধর্ম বিদ্বেষ ও অঞ্চল প্রীতি মানবতার শত্রু ও প্রগতির অন্তরায়। মদীনা সনদ এ দুষ্ট তগুলোকে মুছে ফেলে এবং সামাজিক নিরাপত্তা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে। সনদের প্রতিটি ধারা পর্যালোচনা করলে মহানবী (সা.) এর মানবাধিকার ঘোষণার প্রকৃষ্ট পরিচয় প্রতিভাত হয়। ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইট ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস এ্যাক্ট, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (টহরাবৎংধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং) এর চৌদ্দশত বছর আগে মানবতার ঝান্ডাবাহী মহানবী (সা.) সর্বপ্রথম মানুষের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার ঘোষণা করেন। পরস্পর বিরোধী ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে মহানবী সা. কর্তৃক সম্পাদিত এ সনদ সমগ্র মানবমন্ডলী ও অখন্ড মানবতার এক চুড়ান্ত উত্তরণ।

……………………………………………………………
লেখক :  সম্পাদক- মাসিক ‘আত-তাওহীদ’ চট্টগ্রাম।

Related posts

Leave a Comment