পবিত্র কুরআনের আলোকে পর্দা

সৈয়দা সুফিয়া খাতুন :
পবিত্র কুরআনের সাতটি আয়াতে মহিলাদের পর্দার বিধান বর্ণিত হয়েছে। চারটি আয়াত সূরা আহযাবে, তিনটি আয়াত সূরা নূরে বিবৃত হয়েছে। এসব আয়াতে পর্দার বিধি-বিধানের পূর্ণ বিবরণ বর্ণনা করা হয়েছে।
পর্দা সম্পর্কিত প্রথম আয়াত ঃ
“আর যখন নবীপতœীদের কাছে তোমরা কোন সামগ্রী চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে; এটি তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্র।” (আয়াত ৫৩, সূরা আহ্যাব)
আয়াতে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, নবীপতœীগণ তোমাদের সাথে পর্দা করবেন। তোমরা নবী পতœীগণের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। তবে প্রয়োজনে কথা বলতে দোষ নেই; কিন্তু সামনাসামনি দেখা না হওয়া চাই। এটা তোমাদের এবং তাঁদের পবিত্র থাকার প্রকৃত উপায়। অর্থাৎ এ পর্যন্তু যেমন উভয় পক্ষের অন্তর পবিত্র, ভবিষ্যতেও যেন অপবিত্র হতে না পারে।
উল্লিখিত আয়াতের শানে নুযূলের বিবরণে বিশেষভাবে নবী পতœীগণের উল্লেখ থাকলেও এ বিধান সমগ্র উম্মতের জন্য ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য। এ বিধানের সারমর্ম এই যে নারীদের কাছ থেকে ভিন্ন পুরুষদের কোন কিছু নেওয়া জরুরী হলে সামনে এসে নেয়া যাবে না, পর্দার আড়াল থেকে নিতে হবে বা কোন কিছু দিতে হলেও একইভাবে পর্দার যথাযথ সংরক্ষণ করতে হবে। এই বিধান পুরুষ ও নারী উভয়ের অন্তরকে মানসিক কু-মন্ত্রণা থেকে পবিত্র রাখার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে।
এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, এ স্থলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পুণ্যাত্মা পতœীগণকে পর্দার বিধান দেয়া হয়েছে, যাদের অন্তরকে পাক-সাফ রাখার দায়িত্ম  স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার। যেসব পুরুষকে সম্বোধন করে এ বিধান দেয়া হয়েছে, তারা হলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহাবায়ে কেরাম, যাদের মধ্যে অনেকের মর্যাদা ফেরেশতাদের নিকটও ঈর্ষণীয় ছিল। তাদের আন্তরিক পবিত্রতা থাকা সত্ত্বেও মানসিক কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর জন্য পুরুষ ও নারীর মধ্যে পর্দার ব্যবস্থা জরুরী করা হয়েছে। আজ এমন ব্যক্তি কে আছে, যে তার মনকে সাহাবায়ে কেরামের পবিত্র মন অপেক্ষা এবং তার স্ত্রীর মনকে পুণ্যাত্মা নবীপতœীগণের মন অপেক্ষা অধিক পবিত্র হওয়ার দাবী করতে পারে? আর এটা মনে করতে পারে যে, নারীদের সাথে তাদের মেলামেশা কোন অনিষ্টের কারণ হবে না।
পর্দা সম্পর্কিত উল্লেখিত আয়াতের শানে নুযূল সর্ম্পকে ইমাম বুখারী (রহঃ) দুটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন- হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত এক রেওয়ায়েত হল, হযরত ওমর (রাঃ) একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! আপনার কাছে সৎ-অসৎ অনেক রকমের লোক আসা-যাওয়া করে, আপনি পতœীগণকে পর্দা করার আদেশ দিলে খুবই ভাল হত। এর পরিপ্রেক্ষিতে পর্দার আয়াত নাজিল হয়।
পর্দা সম্পর্কিত দ্বিতীয় আয়াত ঃ
মহিলাদের ঘর হতে বের হওয়ার নিয়মাবলী সম্পর্কিত উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে- হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুমিন নারীদেরকে বলে দিন তারা যেন তাদের চাদর নিজেদের মুখের উপর নামিয়ে দেয়। (আয়াত ৫৯, সূরা আহ্্যাব)
আলোচ্য আয়াতের সারমর্ম হলো যে, মহিলাগণ সমস্ত শরীর ঢাকার সাথে সাথে চাদরের একাংশ মুখের উপর ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
হাদীসে বর্ণিত আছে, এই আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর মুসলিম নারীগণ মুখমণ্ডলসহ গোটা দেহ এমনভাবে ঢেকে বের হতেন যে, দেখার জন্য শুধু একটি চোখ খোলা রাখতেন। এতে প্রমাণিত হয়, ফেৎনার সময় মুখমণ্ডলও ঢেকে রাখা স্বাধীন নারীদের জন্য অত্যন্ত জরুরী। একান্ত ঠেকাবশতঃ দাসীদের জন্য তা জরুরী নয়। কারণ, এতে তাদের কাজ-কর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
আলোচ্য আয়াতে এ শিক্ষাও দেয়া হয়েছে, সফর কিংবা অন্য প্রয়োজনে যদি ঘর থেকে বের হতে হয় তখনও মহিলাগণ পর্দা ত্যাগ করতে পারবে না; বরং সমস্ত শরীর আবৃত করার সাথে সাথে চাদর কিংবা বোরকা দ্বারা মুখমণ্ডল এমনভাবে ঢেকে নিতে হবে যেন কেউ দেখতে না পায়।
এ আলোচনার পর মহিলাদের জন্য মুখমণ্ডল ঢেকে চলা ফরজ কিংবা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশ নেই।
কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সর্বদা ঘরে অবস্থান করাই মহিলাদের জন্য মূল বিধান। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, (হে নারী সকল!) তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান কর।  (আয়াত ৩৩, সূরা আহ্যাব)
কিন্তু যদি কখনও ঘর থেকে বের হওয়ার কিংবা পর-পুরুষের সামনে আসার শরয়ী কিংবা স্বভাবগত কোন প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে প্রয়োজন পরিমাণ প্রকাশ করতে পারবে। স্বভাবগত প্রয়োজন যেমন-বিশেষ প্রয়োজনে কোন আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া কিংবা পুরুষ লোক বা কর্মচারীর অভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করার জন্য বাজারে যাওয়া ইত্যাদি। তবে লম্বা চাদর কিংবা বোরকা দ্বারা আপাদমস্তক ঢেকে বের হতে হবে। পর্দার সাথে এসব কাজ আঞ্জাম দিতে কোন অসুবিধা নেই।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা যেন তাদের চাদরের একাংশ তাদের (মুখমণ্ডলের) উপর ঝুলিয়ে রাখে। আর যদি পর্দার সাথে প্রয়োজনীয় কাজ আঞ্জাম দেয়া সম্ভব না হয়, তাহলে প্রয়োজন অনুসারে পর্দা খোলা জায়েয আছে। যেমনঃ ডাক্তারকে যদি হাতের শিরা দেখানোর প্রয়োজন হয় কিংবা যদি দেহের অন্য কোন স্থানে এমন রোগ দেখা দেয় যে, কাপড়ের উপর থেকে দেখে তার চিকিৎসা করা সম্ভব না, তাহলে প্রয়োজনীয় স্থানটুকু খুলে ডাক্তারকে দেখানো জায়েয আছে। কারণ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ কাজও প্রয়োজন পরিমাণ বৈধতা প্রাপ্ত হয়।
শরয়ী জরুরত যেমনÑ সাক্ষ্য দেয়ার জন্য কাজী কিংবা জজের সামনে উপস্থিত হওয়া। এমতাবস্থায় মুখমণ্ডল খোলা রাখার অনুমতি রয়েছে। অনুরূপভাবে কোন কাফের কিংবা ডাকাত যদি কোন মহিলার ঘরে হামলা চালায়; তাহলে রক্ষার জন্য তাদের মোকাবেলা করা যাবে। মহিলা সাহাবীগণ এ ধরনের পরিস্থিতিতে জেহাদে অংশগ্রহণ করতেন কিন্তু তাঁরা অবাধে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতেন না। মোটকথা, পর্দার সাথে চলা এবং ঘরের চৌহদ্দীতে অবস্থান করাই মহিলাদের জন্য আসল বিধান। কিন্তু প্রয়োজনের সময় প্রয়োজন অনুযায়ী পর্দা হতে বের হওয়ার অনুমতি আছে। প্রয়োজনের অধিক বেপর্দার সাথে গায়রে মাহরামের সামনে যাওয়া সম্পূর্ণ হারাম। পর্দা সম্পর্কে ইসলামী বিধানের সারমর্ম ইহাই।
উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘তারা যেন তাদের চাদরের একাংশ তাদের মুখমণ্ডলের উপর ঝুলিয়ে রাখে’। এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর আনসার মহিলাগণ কালো চাদর পরিধান করে প্রয়োজনে এমনভাবে বের হতেন যে, মনে হত তাদের মাথায় কাক বসে আছে।
চলবে।……

Related posts

Leave a Comment