জাহান্নামের পরিচয় : জাহান্নামীদের জিহ্বা, জাহান্নামীদের উদ্দেশ্যে শয়তানের বক্তব্য, জাহান্নামীদের সংখ্যাঃ

মাওলানা আব্দুল মতিন :
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, নিঃসন্দেহে কাফের তার জিহ্বা টেনে এক ফার্লং বা দুই ফার্লং পর্যন্ত বের করবে। যার উপর দিয়ে লোকজন হেঁটে যাবে। আত্ তারগীব ওয়াত তারহীব
ব্যখ্যা ঃ এক ফার্লং সমান তিন মাইল। এ হাদীস থেকে জানা গেল, কাফেরদের জিহ্বা কত লম্বা হবে। মূলত পরকালে মানুষের আকৃতি পৃথিবীর মানুষের আকৃতির  চেয়ে অনেক দীর্ঘ হবে।
জাহান্নামীদের উদ্দেশ্যে শয়তানের বক্তব্যঃ
এদিকে জাহান্নামীরা শয়তানের অনুসরণের কারণে আফসোস করতে থাকবে। অন্য দিকে আল্লাহর আহ্বানে সাড়া না দেয়ার কারণে হুমকি ধমকি হতে থাকবে। এদিকে শয়তান তার বক্তব্যে তাদের ভীষণভাবে ধিক্কার দিতে থাকবে। কোরআনের ভাষায় শয়তান বলবে- ‘আর (কেয়ামতের) দিন যখন সব মামলার ফয়সালা হয়ে যাবে, তখন শয়তান বলবে (তোমাদের আমাকে ভাল-মন্দ বলা অন্যায়), নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের সাথে সত্য ওয়াদা করেছিলেন, আর আমিও কিছু ওয়াদা করেছিলাম, অতঃপর আমি তোমাদের সাথে আমার কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করেছি। তোমাদের উপর আমার এর চেয়ে বেশি ক্ষমতাও ছিল না, আমি তোমাদের (গোমরাহীর) দাওয়াত দিয়েছি, অতঃপর তোমরা (নিজেরাই) আমার কথা মেনে নিয়েছ, অতএব তোমরা আমাকে ধিক্কার দিও না, বরং নিজেদেরকেই ধিক্কার দাও। তোমরা আমার সাহায্যকারী নও আর আমিও তোমাদের সাহায্যকারী নই। ইতিপূর্বে (দুনিয়াতে) তোমরা আমাকে (আল্লাহর) শরিক সাব্যস্ত করতে, আমি তা অস্বীকার করছি, নিশ্চয়ই জালেমদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ সূরা ইবরাহীমসে দিন বাস্তবেই জাহান্নামীদের আফসোসের কোন সীমা থাকবে না। যখন শয়তান এভাবে সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে নিজের সাফাই প্রকাশ করবে, সে সময় জাহান্নামীদের রাগ গোস্সা কি পরিমাণ হবে তা বলার অবকাশ রাখে না।
জাহান্নামীদের অবস্থা
জাহান্নামে কীভাবে প্রবেশ করবে?কোরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াতে জাহান্নামে প্রবেশের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। সে বর্ণনায় এও আছে, তাদেরকে পিপাসার্ত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। ফেরেশতারা তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করবেন। নিম্নের আয়াতগুলো থেকে যা খুব ভালভাবে বুঝা যায়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন –  ‘ফেরেশতাদের হুকুম করা হবে, জালেম ও তাদের সতীর্থদের এবং তারা আল্লাহকে ছেড়ে যাদের এবাদত করতো তাদের একত্রিত কর, আর তাদের জাহান্নামের প্রবেশের পথ দেখাও। অতঃপর হুকুম করা হবে, তাদের (একটু) দাঁড় করাও (তাদের প্রশ্ন করা হবে), তোমাদের কি হল, তোমরা একে অপরকে সাহায্য করছ না কেন? এ প্রশ্নের পরও তারা কেউ কাউকে সাহায্য করবে না; বরং তারা সবাই সেদিন আত্মসমর্পণ করবে। সূরা সাফ্ফাত:
ইরশাদ হয়েছে-  ‘আমি সীমালঙ্ঘনকারী পাপীদের পিপাসার্ত অবস্থায় জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিব।
সুরা মারইয়ামে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘যে দিন তাদের উপুর করে জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে, সে দিন তাদের বলা হবে, জাহান্নামের স্বাদ গ্রহণ কর।’
‘অতঃপর তাদের এবং ইবলিসের  বাহিনী সবাইকে উপুড় করে জাহান্নামে ফেলা হবে।’ সূরা শুআরা
‘সীমালঙ্ঘনকারী পাপীদের আকার-আকৃতি থেকে চেনা যাবে (তাদের চেহারা কালো এবং চক্ষুসমূহ নীল হবে), তাদের পা ও মাথার চুল ধরে পাকড়াও করা হবে। সূরা আর-রাহমান
আততারগীব ওয়াততারহীব গ্রন্থে এ আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস রা. -এর একটি উক্তি উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, অপরাধীদের হাত পা একত্র করে ফেলা হবে। অতঃপর লাকড়ির ন্যায় ভেঙ্গে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
পুলসেরাত অতিক্রম করতে গিয়ে জাহান্নামে পতিত হওয়াঃ
সেদিন জাহান্নামের উপর পুল স্থাপন করা হবে, যাকে পুলসেরাত বলা হয়ে থাকে। সমস্ত নেককার এবং বদকারকেই এ পুল অতিক্রম করতে হবে। ইরশাদ হয়েছে-
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তা অতিক্রম করবে না, এটা তোমাদের প্রভুর সুনির্দিষ্ট বিধান।’
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, জাহান্নামের পিঠের উপর পূল কায়েম করা হবে, আর আমি নবীদের সকলের আগে আমার উম্মতদের নিয়ে সে পুলসিরাত অতিক্রম করবো। সে দিন শুধু রাসূলগণই কথা বলবেন। সেদিন তাদের কথা হবে (হে আল্লাহ! নিরাপদ রাখুন, নিরাপদ রাখুন)।’
অতঃপর রাসূলুল্লাহ  সা. এরশাদ করেন, জাহান্নামে সা’দান নামক বৃক্ষের কাঁটার ন্যায় বাঁকানো আংটা রয়েছে। সেগুলোর বিশালতা সম্পর্কে আল্লাহ পাকই ভাল জানেন। উক্ত আংটাগুলো বদ আমলের কারণে পুলসেরাত অতিক্রমকারীদের টানা-হেঁচড়া করে জাহান্নামে ফেলতে চেষ্টা করবে। ফলে কিছু লোক ধ্বংস হবে। তারা কাফের হলে জাহান্নামে পড়ে যাবে, আর কখনো তা থেকে বের হতে পারবে না। কেউ ক্ষত বিক্ষত হয়ে জাহান্নামে পড়বে, পরে নাজাত পেয়ে (জান্নাতে) যাবে।  এরা ফাসেক। অন্য বর্ণনায় আছে, কোন কোন মুমিন চোখের পলকে পুলসেরাত অতিক্রম করবে, কেউ বিদ্যুতের ন্যায় দ্রুত গতিতে অতিক্রম করবে, কেউ বাতাসের বেগে অতিক্রম করবে, আবার কেউ ঘোড়ার ন্যায় দ্রুত গতিতে অতিক্রম করবে। কেউ উটের মত হেঁটে আর কেউ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পুলসেরাত পার হবে। বুখারী শরীফ
হযরত কা’ব রা. বর্ণনা করেন, জাহান্নাম সমস্ত মানুষকে তার পৃষ্ঠদেশে জামায়েত করবে। যখন নেককার এবং বদকার সবাই একত্র হবে, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জাহান্নামকে বলবেন, তুমি তোমাদের লোকদের নিয়ে সব জান্নাতীদের ছেড়ে দাও। তখন জাহান্নাম বদকারদের গ্রাস বানিয়ে নিবে আর জাহান্নাম জাহান্নামীদের এমনভাবে চিনবে যেমন তোমরা তোমাদের  সন্তানদের চিন; বরং তার চেয়েও ভালভাবে  চিনবে। ইবনে কাসীর
সারকথা, জান্নাতীরা পুলসেরাত পার হয়ে জান্নাতে পৌঁছে যাবে, তাদের জন্য জান্নাতের দরজা আগে থেকেই খোলা থাকবে, আর জাহান্নামীদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
এ সম্পর্কে কোরআনে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন-
‘অতঃপর আমি তাদের মুক্তি দিব যারা ভয় করত। আর জালেমদের (জাহান্নামে) এমনভাবে নিক্ষেপ করা হবে যে, তারা হাঁটু গেঁড়ে পড়ে থাকবে। সূরা মারইয়াম
জাহান্নামীরা একে অপরকে অভিশাপ দিবেঃ
অপরাধীরা এই দুনিয়াতে একে অপরকে অনেক মহব্বত করে, একে অন্যকে উৎসাহ দিয়ে কুফরী এবং শিরক করে এবং করায়, কিন্তু যখন তারা তাদের বদ আমলের পরিণতি জাহান্নামের সুরতে দেখবে, তখন একে অপরকে লানত দিবে।
সূরা আরাফে বর্ণিত হয়েছে- ‘যখন কোন দল জাহান্নামে প্রবেশ করবে তখন তাদের ন্যায় অন্য দলকে অভিশাপ দিবে, এমনি করে যখন সমস্ত দল সেখানে একত্রিত হবে, তখন পরবর্তী লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের সম্পর্কে বলবে, হে আমাদের রব, এসব লোক আমাদের গোমরাহ করেছিল, অতএব তাদের জাহান্নামে দ্বিগুণ শাস্তি দিন।’জাহান্নামীদের সংখ্যাঃ
রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, হযরত আদম আ. কে সম্বোধন করে আল্লাহ পাক বলবেন, হে আদম! তিনি আরজ করবেন, ‘আমি উপস্থিত, আপনার হুকুম পালনের জন্য আমি প্রস্তুত। সকল কল্যাণ আপনার হাতে)। আল্লাহ জাল্লা শানুহু বলবেন, (তোমার সন্তানদের থেকে) জাহান্নামীদের বের কর। আদম আ. আরজ করবেন, জাহান্নামী কত জন? এরশাদ হবে, প্রতি হাজারে ৯৯৯ জন। একথা শুনে আদম আ. -এর সন্তানরা খুবই পেরেশান ও বিচলিত হয়ে পড়বে। পেরেশানী এত তীব্র হবে যে, গর্ভবর্তীদের গর্ভপাত হয়ে যাবে। লোকজন বেহুঁশ হয়ে পড়বে। প্রকৃতপক্ষে তারা বেহুঁশ হবে না। আল্লাহর আযাবই বড় কঠিন হবে (যাতে তারা বেহুঁশ হয়ে পড়বে)। একথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সা. সে একজন জান্নাতী আমাদের মধ্যে থেকে কে হবে? হুযূর সা. এরশাদ করেন (ভয় পেয়ো না), সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা হাজারে একজন জাহান্নামী হবে তোমাদের মধ্য থেকে আর বাকীরা ইয়াজুজ-মাজুজ থেকে হবে। মেশকাত
উদ্দেশ্য হল, ইয়াজুজ মাজুজের সংখ্যা এত বেশি হবে, যদি তোমাদের এবং তাদের মধ্যে মোকাবেলা হয় তাহলে তোমাদের একজনের মোকাবেলায় তারা হবে এক হাজার। যেহেতু তারাও আদম আ. -এর বংশধর, তাই হিসাব করেই বলা হয়েছে, প্রতি হাজারে তাদের ৯৯৯জন জাহান্নামে যাবে। তারা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টিকারী এবং আল্লাহকে অস্বীকারকারী হওয়ার কারণেই এত অধিক সংখ্যায় জাহান্নামী হবে।

Related posts

Leave a Comment