অপ্রতিরোধ্য এক চ্যালেঞ্জের নাম কুরআন

এইচ এম আবূ সালেহ :
আল্লাহ তায়ালা যেমন অনাদি-অনন্ত, (তাঁর ছিফাত) কুরআনুল কারীমও তেমনি অনাদি-অনন্ত। আল্লাহ তায়ালা সত্বাগতভাবে চিরন্তন, তাই তাঁর ছিফাত নশ্বর বা অচিরন্তন হতে পারে না। কেননা আপন সত্বা ও গুণাবলী এই দুয়ের সম্মিলিত পরিচয়েই তিনি আল্লাহ তা’আলা। হ্যাঁ, অসংখ্য ছিফাতের মধ্যে কুরআনে কারীম আল্লাহ তা’আলার এক অনন্য ছিফাত বা গুণ। এই কুরআনে কারীমকে তিনি অন্যান্য সকল আসমানী কিতাবের শেষে পৃথিবীতে নাযিল করেছেন চ্যালেঞ্জস্বরূপ। এই কিতাবের পর আর কোন কিতাব আসমানী কিতাব বলে গণ্য হবে না। এই কিতাব নাযিলের পর অন্য কোন কিতাবের (মতবাদের) প্রযোজ্যতা অবশিষ্ট থাকবে না। তদুপরি এই কিতাবের মতো কোনো কিতাব উপস্থিত করার কারো সাধ্য নেই, কখনও থাকবে না বলেও আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন। এই কিতাবে অনাগত সকল যুগের সকল মানুষের সকল সমস্যার সমাধান এবং সার্র্বিক শান্তি ও কল্যাণ, নিরাপদ ও উন্নত জীবনের ফর্মূলা প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং অন্য কোন কিতাব বা মতবাদ কুরআনে কারীম নাযিল হওয়ার পর থেকে গ্রহণযোগ্য বা সমর্থনযোগ্য নয়।
এই চিরন্তন ও সকল সমস্যার সমাধানসমৃদ্ধ কিতাব কুরআনে কারীমের বাহক এবং বিশ্লেষক হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সা.। যেহেতু তাঁর উপর এই কিতাব নাযিল করে দ্বীনে ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে এবং আসমানী কিতাব নাযিলের ধারা সমাপ্ত ও পূর্ণ  বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। মুহাম্মদ সা. আনীত কুরআনভিত্তিক দ্বীনের বাইরে অন্য কোন নতুন-পুরাতন দর্শন, বিশ্বাস, মতবাদকে ধর্ম হিসেবে পালন করারও কারো অধিকার নেই। এরপরও কেউ সে অনধিকার চর্চা করলে নিশ্চয়ই তা হবে স্রষ্টার বিরুদ্ধাচরণ, কিংবা অসত্য চর্চা। আমরা এ নিবন্ধে ব্যাখ্যামূলক কোনো আলোচনায় না গিয়ে কুরআনে কারীমের পরিচয়, চিরন্তনতা এবং মুহাম্মদ সা.-এর শেষ ও সর্বকালের নবী হওয়ার দালিলিক প্রমাণ তুলে ধরতেই কেবল সচেষ্ট থাকব।
কুরআনে কারীমের অপ্রতিরোধ্য চ্যালেঞ্জ
মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-
* এ (কুরআন) হলো সেই কিতাব, যাতে কোনই সন্দেহ নাই; সঠিক পথ প্রদর্শক আল্লাহয় ভয়কারীদের জন্য হেদায়াত। সূরা বাকারা-২
* তোমাদের প্রতি আমি নাযিল করেছি এমন এক কিতাব (কুরআন); যাতে রয়েছে তোমাদের সকলের আলোচনা। তোমরা কি তা অনুধাবন করবে না? সূরা আম্বিয়া-১০
*এই কুরআনে মানবজাতির জন্য আমি নানা রকম উদাহরণ (দৃষ্টান্ত) বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছি। তবে অনেকেই সত্যকে অস্বীকার করে! সূরা বনী ইসরাঈল-৮৯
* হে নবী (মুহাম্মদ)! আপনার প্রতি কিতাব (কুরআন) নাযিল করা হয়েছে। আপনার মনে যেন কোনো সংকোচ না থাকে, কুরআন দ্বারা সতর্কীকরণের ব্যাপারে। বিশ্বাসীদের জন্য এ কুরআন বিশেষ উপদেশ। সূরা আ’রাফ-২
* আপনার প্রতি আমি কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছি। যা বিশ্বাসীদের জন্য প্রত্যেক মৌলিক বিষয়ের ব্যাখা, হেদায়েত এবং উপদেশস্বরূপ। সূরা আন- নাহল -৮৯
* এভাবেই আমি কুরআনে কারীমের আয়াতসমূহের বিশদ বর্ণনা প্রদান করি, যাতে অপরাধীদের বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। সূরা আন’আম – ৫৪
* এ হলো সেই প্রজ্ঞাময় (জ্ঞানগর্ভ) কিতাবের আয়াত; যাতে রয়েছে পথ নির্দেশনা ও রহমত, সৎকর্মপরায়ণদের জন্য। সূরা লুকমান – ২
নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছ থেকে তোমাদের কাছে পৌঁছেছে এক আলোকবর্তিকা এবং প্রকাশ্য কিতাব (কুরআন)। আল্লাহ তা’আলা এই কিতাবের দ্বারা (সঠিক পথ প্রদর্শন করেন) শান্তির পথ প্রদর্শন করেন তাদের, যারা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়। সূরা মায়িদা -১৫
নিশ্চয়ই আমিই নসীহতপূর্ণ কুরআন নাযিল করেছি। আর আমিই এর সংরক্ষণকারী (চিরকালের জন্য)। সূরা হিজর -৯
অন্য কোন কিতাব চিরস্থায়ীভাবে সংরক্ষণের দায়িত্ব নেননি আল্লাহ তায়ালা।
* এই কুরআন (নাযিলকালে) সামনের দিক থেকে অথবা  পিছনের দিক থেকে কোন মিথ্যা (বানোয়াট কিছু) এতে প্রবেশ করতে পারেনি; বরং এ কিতাব তো সর্বোচ্চ প্রজ্ঞাময় এবং প্রশংসিত মহান সত্বার পক্ষ থেকে যথাযথভাবে নাযিলকৃত। সূরা হামিম-সেজদাহ-৪২
কুরআনুল কারীম বিকৃত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, যেমন অন্যান্য আসমানী কিতাব বিকৃত হয়েছে।
* মহিমাময় স্বত্বা তিনি; যিনি তাঁর বান্দার (মুহাম্মদ সা. এর) প্রতি সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়ক কিতাব নাযিল করেছেন। যাতে করে তিনি সমগ্র জগতবাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারেন। সূরা ফুরকান -১
*রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই এই কুরআন আল্লাহর রজ্জু, যা আল্লাহর প্রকাশ্য নূর। অব্যর্থ মহৌষধ, দৃঢ় অবলম্বন ধারণকারীর জন্য। আর তা নাজাত অনুসরণকারীর জন্য। বায়হাকী/আল-হাকিম
* অবিশ্বাসীরা কি বলে যে, মুহাম্মদ সা. নিজে এই কিতাব (কুরআন) রচনা করেছেন? বলুন, তাহলে তোমরা এই কুরআনের সূরার মতো একটি সূরা তৈরি করে আনো তো? প্রয়োজনে তোমাদের সহযোগীদের ডেকে আনো, যদি তোমাদের দাবীতে তোমরা সত্যবাদী হও।
* তোমরা (অবিশ্বাসীরা) যদি আমার বান্দার (মুহাম্মদ সা. এর) প্রতি আমার নাযিলকৃত কুরআন বিষয়ে সন্দেহ করো, তাহলে তোমরা কুরআনের অনুরূপ একটি মাত্র সূরা উপস্থিত করো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও তোমাদের কথায়। যদি তোমরা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে একটি সূরাও তৈরি করে আনতে না পারো; আর তা কখনও তোমরা পারবে না; তবে তোমরা সেই অগ্নির আজাবকে ভয় করো, যার ইন্ধন (জ্বালানী) হবে মানুষ এবং পাথর। অস্বীকারকারীদের জন্যই ঐ শাস্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। সূরা বাকারা -২৩
* হে রাসূল! (মুহাম্মদ সা.) আপনি সমগ্র বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিন, যদি পৃথিবীর সকল মানুষ ও জ্বিন একত্রিত হয়ে এই কুরআনের মতো কিছু আনয়ন করতে চেষ্টা করে এবং পরস্পর-পরস্পরকে সহযোগিতা করে তারপরও কখনও তারা তা আনতে সক্ষম হবে না। সূরা বনী ইসরাঈল-৮৮
*আমি এই কুরআনকে নাযিল করেছি সত্য বিধান দিয়ে। সুতরাং একমাত্র আল্লাহর জন্য আনুগত্য প্রদর্শন করে কেবল তাঁরই ইবাদত করো। সূরা যুফার -২
* অন্যান্য দলের; যারা কুরআনকে অস্বীকার করে তাদের প্রতিশ্রুত ঠিকানা জাহান্নাম।
না, কুরআনে কারীমের এই চ্যালেঞ্জ কেউ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। কখনও হবেও না। না বুঝে আকস্মিক জয্বায় দু’ একজন যারা কুরআনের মতো সূরা বানিয়ে ফেলতে পারবে বলে মনে করে চেষ্টা শুরু করেছিল, তারা  যথাবাস্তবতা অনুযায়ী ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টি অমুসলিম মনীষীরাও অকপটে স্বীকার করেছেন। যেমন, বিখ্যাত পাশ্চাত্য পন্ডিত অলাস্টন কুরআনে কারীমের এই চ্যালেঞ্জ যে মোকাবেলা করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয় এবং কুরআনে কারীমের সম্পর্কে মুহাম্মদ সা. এর দাবী যে সম্পূর্ণ সত্য ও নির্ভুল তা অকপটে স্বীকার করেছেন। সেই সাথে ইসলামের প্রতিষ্ঠার ১০০ বৎসর পরে সংঘটিত হওয়া একটি বাস্তব ঘটনার কথাও তিনি বর্ণনা করেছেন। সে ঘটনার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ, ‘‘কুরআনের অসাধারণ মোহিণীশক্তিতে মোহিত হয়ে অসংখ্য মানুষ যখন ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছিল তখন এর বিরুদ্ধবাদীরা ঈসায়ী ৮ম শতাব্দিতে কুরআনের মতো একটি গ্রন্থ রচনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। যাতে মানুষকে কুরআন বিমূখ করা যায়। এই লক্ষ্যে তারা ইরানের বিখ্যাত আরবী সাহিত্যিক ইবনে মুকাফ্ফার (মৃত্যু ৭২৭ খৃ.) শরণাপন্ন হয়। সে যুগে ইবনে  মুকাফ্ফা ছিলেন একজন জবরদস্ত বিদ্যান ও অসাধারণ মেধাশক্তির অধিকারী। নিজের জ্ঞানের প্রতি এতই ভরসা ছিল যে, কুরআন বিরোধীদের চাহিদা মতো সে কুরআনের মতো একটি গ্রন্থ রচনা করে দিতে সম্মত হয়ে যায়। সব রকম  উপাদান, সুযোগ-সুবিধা প্রদানের শর্ত দিয়ে এক বছরের মধ্যেই ঐ প্রস্তাবিত কিতাব লিখে দেওয়ার ওয়াদা করে কাজ শুরু করেন ইবনে মুকাফ্ফা। (নাউযুবিল্লাহ।)
এরপর দীর্ঘ ছয়মাস পর ঠিকাদাররা আসে কুরানের অনুরূপ গ্রন্থ রচনার কাজে ইবনে মুকাফ্ফা কতটুকু এগিয়েছে তা জানতে। ইবনে মুকাফ্ফার নির্দিষ্ট রুমে ঢুকে তারা দেখতে পায় গভীর চিন্তায় মগ্ন ইবনে মুকাফ্ফার হাতে কলম আছে বটে; কিন্তু সে কলম লিখছে না। তিনি নিশ্চুপ বসে। এই সাহিত্য বিশারদের মুখের সামনে এক টুকরো কাগজ পড়ে আছে। এ ছাড়া ঐ রুমে চতুর্দিকে ছেড়া কাগজের স্তুপ দেখা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কুরআনবিরোধী কিতাব লেখানোর ঠিকাদারদের সামনেই তিনি তাঁর অক্ষমতা স্বীকার করলেন। এই সাহিত্য সম্রাট তার সমগ্র জীবনের লব্ধ জ্ঞান-বিদ্যা, মেধা-যোগ্যতা খাটিয়ে ছয় মাসেও যে কোন সফলতা অর্জন করতে পারলেন না তাঁর বিবরণ দিয়ে বললেন, ‘কুরআনের সমকক্ষ মাত্র একটি বাক্য রচনা করতে আমি ছয় মাস গভীর মনোযোগী হয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমি তাতে ব্যর্থ হয়েছি। ছেড়া কাগজের স্তপই তার প্রমাণ। আপনারা আমাকে ক্ষমা করুন। আমার দ্বারা কোনোভাবেই কুরআনের সমকক্ষ একটি সূরা বা বাক্য রচনা করা সম্ভব নয়।’

Related posts

Leave a Comment