আত্মশুদ্ধি : পথ ও পাথেয়

আল্লামা মুহাঃ সালমান মানছুরপুরী :
ভাষান্তর: মাওলানা পিয়ার মাহমূদ :

আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তাঃ অন্তরকে সর্ব প্রকার চারিত্রিক ও আত্মিক ব্যধি থেকে পবিত্র রাখার জন্য আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন হয়। যার মূল কথা হলো, কলবকে এ পরিমাণ পাক-পরিষ্কার করা যে, কলবের ভিতর সর্বপ্রকার নিকৃষ্ট গুণাবলীর প্রতি ঘৃণা ও সর্ব প্রকার উত্তম গুণাবলীর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। মানুষের অন্তর যখন পরিশুদ্ধ এবং  আলোকিত হয় তখন তার জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সহজ হয়ে যায়। তাইতো পবিত্র কুরআনে প্রিয় নবীর সা. জিম্মাদারী ও দায়িত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে  ইরশাদ হয়েছে- ‘‘এবং তিনি তাদের পরিস্কার ও পরিশুদ্ধ করেন। সত্যিই প্রিয় নবী সা. হযরত সাহাবা রা. -এর ইসলাহ ও আত্মশুদ্ধির প্রতি পূর্ণ খবরদারী করেছেন। তাই তো তাঁরা তার নূরানী সোহবত ও শানদার তারবিয়াত এর বদৌলতে উম্মাহর আগত ওলী আওলিয়া ও উলামা-মাশায়েখ থেকে উৎকৃষ্ট বলে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এবং নবুওয়তের ভাষায় ‘নুযুমে হিদায়াত’ তথা হিদায়াতের উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজী উপাধীতে ভূষিত হয়েছেন। আত্মশুদ্ধির পর তাদের উত্তম ও সুউচ্চ গুণাবলী কি ছিল!  সে সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. -এর বর্ণনা এই যে, কারো অনুসরণ করতে চাইলে সে যেন মৃত ব্যক্তিদের অনুসরণ করে।
কারণ, জীবিত মানুষ ফিৎনা থেকে নিরাপদ নয়। সেই অনুসরণীয় ব্যক্তিরা হলেন, হযরত সাহাবায়ে কেরাম রা.। যারা ছিলেন এই উম্মতের সর্বৎকৃষ্ট মানুষ। যাদের অন্তর ছিল সবচেয়ে বেশি পবিত্র এবং যাদের ইলমে ছিল সবচেয়ে বেশি গভীরতা, কৃত্রিমতা ছিল অত্যন্ত কম। যাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ পাক স্বীয় নবীর সাহচার্য এবং স্বীয় দ্বীনের সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য নির্বাচন করেছিলেন। তাই তোমরা তাদের মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হও ও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ কর এবং যথাসম্ভব তাদের আখলাক ও সিরাতকে দৃঢ়তার সাথে আকড়ে ধর। কারণ, তাঁরা ছিলেন সিরাতে মুস্তাকিম – সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত। মুজাহিরে হক: ১/৯৩  মোদ্দা কথা, দিলকে পাষাণত্ব থেকে হিফাজত করে পবিত্র করা এবং নেক আমলের অভ্যাস গড়ে তোলা প্রত্যেক মুমিনের অবশ্য কর্তব্য। এ জন্য প্রচেষ্টা ও উন্নত সাহস  থাকা প্রয়োজন। আত্মশুদ্ধির পথে যে যত বেশী অগ্রসর হবে আল্লাহর নৈকট্যও সে তত বেশী অর্জন করতে পারবে এবং মাওলার রহমতের দ্বারা সিক্ত হবে।
আত্মার চিকিৎসাঃ এখন প্রশ্ন হল আত্মশুদ্ধি কিভাবে অর্জিত হবে? এবং অন্তরকে আত্মিক রোগ ও অপসংস্কৃতি থেকে নিরাপদ রাখার জন্য কি তদবীর ও ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করা হবে? এ ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রিয় নবী সা. ইরশাদ করেন-

إن لكل شيئ صقالة وصقالة القلوب ذكر الله وما شيئ أنجى من عذاب الله  من ذكر الله
প্রত্যেক বস্তুর পরিষ্কার করার যন্ত্র রয়েছে। আর দিল পরিষ্কার করার যন্ত্র হলো যিকরুল্লাহ তথা আল্লাহর যিকির। আর আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষাকারী হিসেবে যিকিরের চেয়ে অধিক প্রভাবশালী কোন বস্তু নেই। বায়হাকী, শুআবুল ঈমান:১/৩৯৬, কাঞ্জুল উম্মাল:১/২১২ অন্য বর্ণনায় রয়েছে ‘যিকির হল অন্তরসমূহের শিফা বা রোগ মুক্তির মহৌষধ।’ কাঞ্জুল উম্মাল: ১/২১২
হযরত আবু দারদা রা. বলেন, অন্তরসমূহ পাক করার মাধ্যম হলো যিকরুল্লাহ। শুআবুল ঈমান:১/৩৯৬     যত বেশি মাওলার যিকরে নিজেকে লিপ্ত রাখা হবে ততই দিল পরিষ্কা হবে, কল্যাণ প্রাপ্ত হবে এবং দিলের রোগ ব্যাধি দূর হবে। ফলে দিলে আসবে ইতমিনান ও প্রশান্তি। আল্লাহ পাক বলেন-
‘যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর যিকর দ্বারা দিলে প্রশান্তি পায়, শোন! আল্লাহর যিকর দ্বারাই দিলে ইতমিনান আসে। সূরা রাদ:২৮ এটা তো খুবই সাধারণ কথা যে, মানুষ তখনই আত্মতৃপ্তি লাভ করে যখন ভবিষ্যত জীবনে কোন ভয়-আশঙ্কা না থাকে। আর যে ব্যক্তি গোনাহগার অপরাধী সে কখনো আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারে না। কারণ, বদ আমলের শাস্তির শংকা সর্বদাই তার আচল ধরে রাখে। জীবনকে করে তুলে পঙ্কিল। সুতরাং বুঝা গেল দুনিয়া ও আখেরাতে ঐ ব্যক্তিই শান্তি ও নিরাপদে থাকতে পারে যে নিজেকে আল্লাহর যিকরে মাশগুল রাখে।
বেশি বেশি ইস্তিগফার দ্বারা দিল পরিষ্কার হয় যিকরের সাথে সাথে বিশেষ করে ইসতিগফারকেও হাদীস শরীফে দিলের পঙ্কিলতা মুক্তি ও পবিত্রতার মাধ্যম বলা হয়েছে। এক বর্ণনায় নবী করীম সা. ইরশাদ করেন,

إن للقلوب صدأ كصدء النحاس وجلاؤها الاستغفار
‘তামা ও লোহার ন্যায় দিলেও মরিচিকা পড়ে। এই মরিচা ছাফ করার মাধ্যম হলো ইস্তেগফার। তাবারানী:কিতাবুদদুআ: ৫০৬ অপর এক বর্ণনায় রাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেন,
‘আমার দিলে ধূলা-ময়লা পড়ে যায়। তাই প্রতিদিন ১০০ বার ইসতিগফার পড়ি।’ অন্যান্য হাদীসেও বেশি বেশি ইসতিগফার করার তাক্বীদ এসেছে।
ইসতিগফারের মাধ্যমে দিলের পরিষ্কার করণের আসল কারণ হলো গুনাহের জন্য অনুতাপের সাথে যখন মানুষ ইসতিগফার করবে তখন লজ্জার কারণে আপনা আপনি দিলে নরমী ও কোমলতা সৃষ্টি হবে এবং মাওলার বড়ত্ব ও নিজের অপরাগতা অনুভব হবে। এই অনুভূতি আত্মশুদ্ধির অধিক কার্যকর কৌশল।
নেককারদের সংসর্গ
অন্তরের পরিচ্ছন্নতার জন্য আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবত অসাধারণ ক্রিয়া করে। কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
‘নামায আদায়কারীদের সাথে নামায আদায় কর এবং ‘সত্যবাদীদের সাথে থাকো। এরূপ হিদায়াত দিয়ে এই দিকে নির্দেশনা করেছেন যে, আমালে ছালেহার প্রতি শওক ও আগ্রহ এবং আমালে সাইয়্যিআর প্রতি অনীহার যোগ্যতা অর্জনের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী বান্দাদের সান্যিধ্যে কাটানো এবং তাদের ফয়েয ও বরকতের আচল শক্তভাবে আকড়ে ধরাও অত্যন্ত উপকারী মাধ্যম। পবিত্র রমজান মাসের রোজাও এই উদ্দেশ্যেই ফরজ করা হয়েছে। যাতে মানুষ এমন পরিবেশ পেয়ে যায়  যাতে একনিষ্ঠ ও একাগ্রতার সাথে আনুগত্য ও ইবাদতে লিপ্ত থাকতে পারে এবং পাপের হাতছানী থেকে নিরাপদ থাকে।
শায়খে কামিলের সাহচর্য
অভিজ্ঞতা বলে দিলের পবিত্রতা শুধু কিতাব মুতালাআ ও জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার সঞ্চয় করার দ্বারা অর্জিত হয় না। এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন আল্লাহর মারেফাতপ্রাপ্ত আওলিয়াদের সোহবত ও তাদের পরামর্শ মুতাবিক জীবন পরিচালনা করা। এজন্য জরুরী হলো, যেভাবে মানুষ দৈহিক রোগ ব্যধির সূ-চিকিৎসার জন্য অভিজ্ঞ-দক্ষ ডাক্তার খোঁজে বের করে নিজেকে তাঁর নিকট সোপর্দ করে দেয় এবং তার (প্রেসক্রিপ্শন অনুযায়ি চলে ও বিধি নিষেধ পুরোপুরি মেনে আরোগ্য লাভ করে; ঠিক সেভাবে আত্মিক রোগ-ব্যধির সূ-চিকিৎসার জন্যও অভিজ্ঞ ডাক্তার খোঁজা উচিত। দিলের ভিতর লুক্বায়িত অন্তরের সুক্ষè রোগের চিকিৎসা নিজে নিজে কোন ব্যক্তি করতে পারে না। (সে যত বড় ব্যক্তিই হোক) নফসের এবং শয়তানের ধোঁকা এত সুক্ষ ও সুপ্ত যে মানুষ নিজে তা বুঝতে পারে না। অধিকাংশ সময় এমন হয়, যে বস্তুকে সে ইবাদত মনে করছে তা-ই তার দ্বীনি তরক্বী ও উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায়। এ জাতীয় রোগ কেবল শায়খে কামিলই চিনতে পারে।
শায়খে কামিলের পরিচয়ঃ
এটা কিভাবে জানা যাবে যে, কে শায়খে কামিল আর কে শায়খে নাকেছ? এ ব্যপারে মুজাদ্দিদে মিল্লাত হাকীমুল উম্মত মাও আশরাফ আলী থানবী রহ. নিম্ন বর্ণিত ১০টি আলামত বর্ণনা করেছেন, যা  দেখে শায়খে কামিলের পরিচয় লাভ করা যায়। তিনি বলেন, শায়খে কামিল তিনি যার ভিতর নিম্নোক্ত ১০টি আলামত রয়েছে। (১) প্রয়োজন পরিমাণ ঈলমে দীনের অধিকারী। (২) আমল-আখলাকে শরীয়তের পাবন্দ। (৩) দুনিয়ার লোভ নেই, এবং পরিপূর্ণতার দাবী করে না। কারণ এটাও দুনিয়ারই অংশ। (৪) কোন শায়খে কামিলের সাহচর্য গ্রহণ করেছে। (৫) সমকালিন হক্কানী উলামা মাশায়েখ তাকে যোগ্য ও সঠিক মনে করেন। (৬) সাধারণ মানুষের তুলনায় বুদ্ধিমান দ্বীনদার ও উলামাগণ তার প্রতি আকৃষ্ট ও তার ভক্ত। (৭) যারা তার মুরীদ তাদের সিংহভাগ শরীআতের অনুসারী ও তাদের দুনিয়ার মোহ কম। (৮) ঐ শাইখ তালীমও তালকীনে স্বীয় মুরীদানের হালতের উপর আন্তরিক এবং তাদের কোন খারাপ কথা শুনে বা দেখে তাদের সাজা দেন। (৯) তার সোহবতে কয়েকবার বসার দ্বারা দুনিয়ার মুহাব্বত হ্রাস পায় এবং আল্লাহর মুহাব্বাতের উন্নতী অনুভত হয়। (১০) শায়খকেও যাকির ও আমলকারী হতে হবে। কারণ নিজে আমল না করে অন্যকে আমলের তালীম দিলে তাতে বরকত হয় না। যে ব্যক্তির মাঝে উপরোক্ত আলামতগুলো পাওয়া যাবে ধরে নিতে হবে সে শায়খে কামিল ও হক্কানী পীর। তাঁর থেকে কোন কারামত প্রকাশ পায় কি না, তার কাশফ হয় কি না অথবা সে যা দোয়া করে তা কবুল হয় কি না! এসব দেখার প্রয়োজন নেই। কারণ এসব বিষয় শায়খে কামিল ও বিলায়াতের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয় নয়। এসলাহী নেছাব: কাসদুসসাবিল:৫১৮
আরহামুর রাহীম আল্লাহর মেহেরবানীতে কোন যুগেই উল্লেখিত গুণে গুনান্বিত ওলী-আউলিয়া ও আল্লাহর পরিচয়প্রাপ্ত বান্দাগণের অনুপস্থিতি ছিল না। আল-হামদু লিল্লাহ আজও এমন অনেক আকাবির আমাদের সামনে উপস্থিত আছেন, যাদের সোহবতে থেকে হাজার হাজার মানুষ আত্মশুদ্ধির মেহনতে লেগে আছে। সমস্ত বুযুর্গানে দীনের মাধ্যমে বিশেষ আমাল ও ওযীফার যে মশক করানো হয়, তার সর্ব শেষ মাকছুদ ইহাই যে, সালিকীন ও তালিবীনের মাঝে সিফাতে ইহসানী প্রকাশ ঘটা অর্থাৎ গাফলত ও উদাসিনতার পর্দা উঠে অন্তর ঈমানী নূরে পরিপূর্ণ হয়। যার আলোতে চলা-ফেরা, উঠা-বসাতে সর্বদায় আল্লাহর জাতের ভয় মনে জাগ্রত হয় এবং ‘আল্লাহর ইবাদত এভাবে কর যেন তুমি তাঁকে দেখছো, যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত এ কল্পনা কর যে, স্বয়ং আল্লাহ তোমাকে দেখছেন,’ (মুসলিম:১/২৭) এর মাকাম অর্জিত হয়ে যায়। তাছাউফ ও সুলূকের যাবতীয় মেহনতের সারমর্ম ও উদ্দেশ্য ইহাই। অন্যান্য বিশেষ সংখ্যার যিকরের তালীম আসল মাকছুদ নয় এবং শরয়ী দৃষ্টিকোনে ওয়াজিব, ফরজও নয়; বরং এই বিশেষ পদ্ধতিমূলত আত্মিক রোগের চিকিৎসা এবং এই রোগ দূর করার তদবীর মাত্র। যেগুলো শায়খে কামিল পথচালকের অবস্থা ও প্রয়োজনের তাকিদে বাতলে দেন। এখন যদি কোন ব্যক্তি এগুলোকেই আসল মনে করে বসে এবং চুড়ান্ত মাকছুদ তথা ‘সিফাতে ইহসানী’ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, তাহলে নিশ্চয় সে ভ্রান্তিতে রয়েছে। এবং তাসাউফ ও সুলূকের হাকীকত সম্পর্কে সে বেখবর।
আরিফ বিল্লাহ হযরত রায়পুরী রহ. এর ইরশাদ-
এই বিষয়টিকেই আরো স্পষ্ট করে স্বীয় যামানার ছাহিবে মারিফাত ও রাহে সুলূক রহস্যবিদ হযরত মাওলানা শাহ আঃ কাদীর রায়পুরী রহ. ইরশাদ করেন, মাওলার মুহাব্বত ও ভালবাসা এবং সর্বদা তাঁর ও তার সন্তুষ্টির ধ্যান ও ফিকির করা এবং তাঁর থেকে কোন সময় গাফিল না হওয়া দীনে ইসলামের কাম্য। কুরআন ও হাদীসের দ্বারা জানা যায় যে, এই অবস্থা ছাড়া ঈমান ও ইসলাম  পরিপূর্ণ হয় না। তবে রাসূলের যামানায় (দীনের তালীম ও তরবীয়াতের ন্যায়) এই ঈমানী অবস্থা শুধু হুযুর সা.-এর সোহবতের দ্বারাই অর্জন হয়ে যেত এবং হুযুর সা. -এর ছোহবতের ফয়েজ ও বরকতে ছাহাবা কিরামের ছোহবতেও এই তাছীর ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে পরিবেশ খুব বেশি বিগড়ে যাওয়ায় এই যোগ্যতার ঘাটতি হওয়ার কারণে এই উদ্দেশ্য অর্জনে কামিলীনের সংসর্গ যথেষ্ট রইল না। তাই দীনের এই বিভাগের ইমামগণ উল্লেখিত কাইফিয়াত অর্জন করার জন্য সোহবতের সাথে ‘ যিকর ও ফিকরের আধিক্যকে যোগ করলেন।
অভিজ্ঞতায় এই নতুন সংযোজন কার্যকরী প্রমাণিত হল। এমনভাবে কোন কোন মাশাইখ স্বীয় যামানার মানুষের অবস্থা উপলব্ধি করে তাদের নফসকে দমন ও দুর্বল এবং প্রবৃত্তিকে দমিয়ে তবিয়তে নমনীয়ভাব সৃষ্টি করার জন্য বিশেষ ধরনের কষ্ট-মুজাহাদা নির্বাচন করেছেন। ফিকরের ক্রিয়া বৃদ্ধি এবং তবীয়তে কোমলতা ও একাগ্রতা সৃষ্টি করার জন্য ‘যরব’ এর পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এগুলোর মধ্য হতে কোনটিকেই মূল উদ্দেশ্য মনে করা হয় না; বরং এ সবকিছুই তদবীর মাত্র। এজন্যই উদ্দেশ্য অর্জিত হওয়ার পর ঐ বর্ণিত পদ্ধতিগুলো ছেড়ে দেয়া হয়। এবং তরীকতের ইমামগণ স্বীয় যামানার অবস্থা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ঐ সমস্ত পদ্ধতিতে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে থাকেন ও এখনো করছেন। এমনকি কখনো কখনো একই শায়েখ একেক সালিকের একেক ধরনের আমল বাতলে দেন। আর কতক সালিকের অবস্থা এমন হয় যে তার এ জাতীয় কোন আমলেরই প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ তাআলা তাকে এমনিতেই সেই যোগ্যতা দান করেন। উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, উল্লিখিত আমালগুলো শুধু চিকিৎসা ও  তদবীর হিসেবেই প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে দেয়া হয়। এতে আরো বুঝা গেল যে, তাসাউফ ও সুলুকের রাস্তায় মেহনত করা দ্বীন বহির্ভূত কোন বিষয় নয়; বরং শরীয়তের রূহকে মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌছাঁনোরই অপর নাম তাসাউফ। এই সেই তাসাউফ যার বদৌলতে হাজার হাজার আল্লাহ প্রেমিক ও সত্য সন্ধানী লোক আল্লাহর প্রেমে হয়েছে তৃপ্ত এবং  পেয়েছে সত্যের সন্ধান।

তাসাউফ দ্বীনি খেদমতের জন্য অন্তরে জ্বালা সৃষ্টি করে
তাসাউফ দ্বীনি খিদমতের পথে বাধা নয়; বরং তাসাউফ হলো দীনি খিদমতের জান ও রূহ। এই জন্যই উলামাগণ লিখেছেন, সৃষ্টিজীবকে প্রত্যক্ষ উপকরণ (তালীম ও তাদরীস) এবং পরোক্ষ উপকরণ (সুলূক ও তারবিয়ত) পৌঁছানোর হকদার ঐ ব্যক্তিই যে নিসবাতে বাতেনী (আত্মশুদ্ধি) দ্বারা সমৃদ্ধ। এই দীন এই জাতীয় আসহাবে নিসবত খাদিমগণের মাধ্যমেই পুরো দুনিয়ায় বিস্তৃতি লাভ করেছে। শুধু মাত্র ইলম দ্বারা কেউ পরিপূর্ণ ফয়েয পায় না। সাথে প্রয়োজন নিসবতের ‘চাশনী’। নিসবতে বাতিনী এর বর্ণনা দিতে গিয়ে হাকীমুল উম্মাত হযরত থানবী রহ. বলেন, ‘নিসবতে বাতিনী হাছিল হওয়ার আলামত দুটি- (১) যিকর ও আল্লাহর স্মরণে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হওয়া যে, কখনো গাফলত ও বিস্মৃতি আসেনা এবং এ ব্যপারে খুব বেশি কষ্টও করতে হয় না। (২) আল্লাহর আনুগত্য অর্থাৎ ইবাদত, মুআমালাত-মুআশারাত, আখলাক, কথা ও কাজে শরীয়তের বিধি-বিধান অনুসরণের প্রতি এমন আগ্রহ এবং শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি এমন ঘৃণার সৃষ্টি হয় যেমন আকর্ষণীয় ও নন্দিত বস্তুর প্রতি তবিয়ত আসক্ত হয় এবং বিশ্রী ও নিন্দিত বস্তু তবিয়ত অপছন্দ করে এবং দুনিয়ার প্রতি লোভ লালসা দিল থেকে বের হয়ে যায়।  যেন তার শান হয়ে যায় কুরআন।
অবশ্য আকস্মিক অলসতা ও ওয়াসওয়াসার কারণে আমলে কমতী হওয়াটা উপরিউক্ত আগ্রহ ও ঘৃণার বিরোধী নয়। ইসলাহী নিসাবে সংযুক্ত  কছদুস সাবীল: ৫৩২
এই বিষয়টি সুষ্পষ্ট যে, এমন সাহেবে নিসবতের দ্বারা মাখলূকের যতখানি উপকার হবে অন্যান্যদের খিদমতে ততখানি উপকার মাখলুকের হবে না। এ জন্য কওমী মাদরাসার ফুযালাগণের অবশ্য কর্তব্য হলো ইলমে নববী অর্জনের পাশাপাশি কোন শায়খে কামেলের সুহবতের মাধ্যমে নিজের ইসলাহ অর্জন করা। এতে সে যখন খিদমতের ময়দানে পা রাখবে তখন তার মাধ্যমে হেদায়াতের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়রবে।
একটি সতর্কবাণী: অনেক দুনিয়াদার অর্থলোভী লোক পীর মুরশিদের সুরত ও লেবাস ধারণ করে তাসাউফ ও তাযকিয়ার নামে শিরক ও বিদআতের দোকান খুলে বসেছে। তাসাউফকে শরীয়আত থেকে আলাদা করে গোমরাহী ও পথ ভ্রষ্টতার জাল বিছিয়েছে। ব্যবসাকে রমরমা করার লোভে মাজার-পুজাসহ শত সহস্র শরীআত গর্হিত কাজের দ্বার খুলেছে। ভাল করে বুঝা উচিত, যে তাসাউফ শরীআত বিরোধী কোন হুকুম দিলে তা তাসাউফ নয়, বরং তা ইবলিসী চাল। এজন্য এ জাতীয় বাতিল ও গোমরাহ পীরদের দেখে হক্কানী পীর মুরশিদগণের ধারণা খারাপ করা যাবেনা। মোট কথা আত্মশুদ্ধির জন্য গ্রহণযোগ্য পীর মুরশিদদের আচল মুজবুতভাবে আকড়ে ধরা উচিত। এতে ইবাদত ও আনুগত্যের রাস্তা সহজ হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে প্রকৃত তাযকিয়া দান করুন। আমীন।

Related posts

Leave a Comment