লাশকাটা ঘরে !!

Photo: একটি ভিনদেশি গল্প 

কেউ আপনারা টোকিওর আসাকাসাতে এলেই দেখতে পাবেন, আসাকাসা রোডের ধারে "কি-নো-কুনি-যাকা' নামে একটা ঢাল আছে। এটার মানে হল 'কি' প্রদেশের ঢাল। আমি জানি না, এটার নাম কেন 'কি' প্রদেশের ঢাল হল। সেই ঢালের এক ধারে দেখতে পাবেন একটি পুরোনো মোটেল। অনেক বড় আর প্রশস্ত। মোটেলের চারপাশের খালি জায়গাটুকুর কোথাও কোথাও ঘন এবং লম্বা সবুজ ঝোপঝাড়ে ঢাকা। রাস্তার আরেক পাশে সম্রাটদের প্রাসাদের সুউচ্চ দেয়াল লম্বা হয়ে রাস্তার সাথে সাথে চলে গেছে।

অনেক অনেক আগে, টোকিওতে যখন রাস্তায় বিজলী বাতি আসেনি অথবা মানুষে টানা রিক্সা গাড়ি চলা শুরু করেনি, তখন আসাকাসার এই ঢালটা ছিল ভীষন ভয়ঙ্কর আর নির্জন। মানুষ পারতঃপক্ষে সূর্য ডোবার পরে এ রাস্তা দিয়ে কখনই যেত না । কখনও কোন পথচারীর সূর্যডোবার পরে বাড়ি ফিরতে হলে "কি-নো-কুনি-যাকা' অনেক লম্বা পাহাড়ি পথ ঘুরে বাড়ি ফিরত, তবুও এ পথ দিয়ে যেত না।

কারণ তখন রাত হলেই "মুজিনারা" পথে নেমে আসত।

সব শেষ যে মানুষটি এক মুজিনাকে দেখেছিলেন, তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি কাছেই কোবায়েশী কোয়ার্টারএ থাকতেন। বছর তিরিশেক আগেই তিনি মারা যান।

একদিন রাতে তিনি কি ভাবে মুজিনা দেখেছিলেন, তার গল্পই আজ বলবো।

একদিন রাতে সেই ব্যবসায়ী তাড়াহুড়ো করে "কি-নো-কুনি-যাকা'র ঢাল পার হচ্ছিলেন। তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন, মোটেলের ধারে, গুটিসুটি মেরে হাঁটুতে মুখ গুঁজে এক মেয়ে ভয়ঙ্কর ভাবে কাঁদছে। তিনি ভয় পেলেন এই ভেবে যে, এই অন্ধকারে, এই নির্জন রাস্তায় মেয়েটা কি ভাবে এল? আর কেনই বা কাঁদছে? ডুবে টুবে মরবে না তো!

তিনি কোন শব্দ না করে, মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে, মেয়েটার পাশে এসে দাঁড়ালেন। "মেয়েটাকে দেখে ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। পরনে দামী পোশাক। চুল বাঁধার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে, কুমারী মেয়ে।" তিনি ভাবলেন।

কিছুটা বিষ্ময় নিয়ে তিনি মেয়েটার আরও কাছে এগিয়ে এলেন, তারপর বললেন, "ও-জোচু" তুমি কাঁদছ কেন? কেঁদ না। তোমার কি হয়েছে আমাকে খুলে বল, দেখি তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারি কিনা? তোমাকে সাহায্য করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে।

ভদ্র লোক প্রকৃতই বেশ দয়ালু ছিলেন। তাই তিনি কথা গুলো মন থেকেই বলছিলেন।

কিন্তু মেয়েটা তার লম্বা হাতায় মুখ ঢেকে কেঁদে যাচ্ছে তো কেঁদেই যাচ্ছে। একবারও মুখ তুলে তাকাচ্ছে না।

ভদ্রলোক আবার বললেন, "ও-জোচু" তুমি কেঁদ না। লক্ষী মেয়ে আমার, কথা শোন প্লীজ! জায়গাটা মোটেও ভালো নয়। আর তোমার মত একটা যুবতী মেয়ের এখানে থাকা একেবারেই নিরাপদ নয়।

আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, কি হয়েছে আমাকে খুলে বল? দেখি তোমার জন্য আমি কিছু করতে পারি কিনা?

ভদ্রলোকের অনুরোধে তাকে পেছনে রেখে, মেয়েটা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো । তখনও সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। হাত দিয়ে মুখ ঢাকা। ভদ্রলোক চেষ্টা করে যেতেই লাগলেন, তিনি বললেন, "ও-জোচু, আর কেঁদ না প্লীজ। আমর কথা শোন, লক্ষী বোন আমার! বলে, তিনি মেয়েটার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলেন। মেয়েটা এবার তার দিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়ালো। তার মুখ থেকে যেন খসে পড়ল, লম্ব হাতাটা। মেয়েটা তার অব্য়বে হাত বুলিয়ে, সেই ব্যবসায়ীর দিকে এগিয়ে এল। আবছা অন্ধকারে তিনি দেখলেন। একটা ভয়ঙ্কর অবয়ব- যেখানে চোখ, নাক,কান, মুখ কিছু নেই।

আর তখুনি চারিদিকটা কেমন অন্ধকার আর শূণ্য হয়ে গেল। তিনি দিগ্বিদিকশূণ্য হয়ে ভয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলেন। একবারও পেছন ফিরে তাকালেন না। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কতক্ষণ মনে নেই, তিনি দূরে একট বাতির আলো দেখতে পেলেন। দূর থেকে টিমটিমে আলোটুকুকে জ্বোনকির আলোর মত লাগছিল।

তিনি ভাবছিলেন, এ আলো নিশ্চই "সোবা" দোকানীর কাছে থেকে আসছে কারণ যেখানে তিনি আলোটা দেখলেন, সেখানে রাস্তার ধারে তার এক চেনা দোকনী "সোবা" বিক্রী করেন। যেই থাক না কেন? তিনি ঐ আলো লক্ষ্য করে দৌঁড়াতে শুরু করলেন।

তারপর হুড়মুড় করে এসে তিনি সোবার দোকানে ঢুকে ধপাস করে বসে, শব্দ করে কেঁদে উঠলেন।

এখানে, এখানে, সোবার দোকনী রুক্ষ স্বরে লোকটিকে কাছে ডাকল। "কেউ মেরেছে নাকি আপনাকে? ব্যাথা পেয়েছেন?

না না, ব্যাথা পাইনি- শুধু---------

শুধু কি? ভয় দেখিয়েছে? লোকটার গলা খসখসে, কোন সহানুভূতি নেই। ডাকাত নাকি?

না না! ডাকাত নয়। ভীত সন্ত্রস্ত লোকটা একটা ঢোক গিলে, কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমি ----আমি এক মেয়েকে দেখলাম মোটেলের পাশে------ তার মুখটা দেখে------ওহ! আমি বলতে পারবো না, কি দেখলাম।

সোব দোকানী চেঁচিয়ে বলল, সে কি তোমাকে খুব ভ্য় দেখিয়েছে? ঠিক এরকম একটা মুখ দেখিয়েছে? ঠিক আমার মত---- মুখের ওপরেরটা ডিমের মত সমান?

লোকটা সোবার দোকানীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, একটা অবয়ব তাতে কোন নাক, মুখ আর চোখ নেই।

ভালো লাগলে লাইক দিয়েন

ঝির ঝির শব্দে একটানা বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। চারপাশ নিস্তব্দ- নিশুতি রাত মনে হলেও রাত মাত্র সাড়ে এগারোটা। কিন্তু এই মিরস্বরাই মেডিক্যাল এর লাশ ঘরের চারপাশে যেন নেমে এসেছে নিঝুম অন্ধকার-সাথে টিপটিপ বৃষ্টি। সালাম একটু আগে ভ্যান নিয়ে এসেছে এখানে। উদ্দেশ্য ছিল রমেশ ডোম কে লাশ টা বুঝিয়ে দেবে। পুলিশ কেস। লাশ টা একটা যুবতী মেয়ের। বয়স আন্দাজ ২৪ হবে। স্বামীর সাথে রাগ করে বিষ খেয়েছে। পুলিশ আসতে আসতে ফুলে ঢোল হয়ে গেছে লাশ। ফোলা লাশটা কে মেডিক্যাল এ ময়না তদন্ত করতে পাঠিয়েছে সালাম কে দিয়ে। সালাম এই লাশ বহনের কাজ করছে চার বছর ধরে। এই সব কাজে কখনো ভয় পায়নি সে। আরও বেশ ভালই লাগে ওর।অনেক দূর থেকে লাশ নিয়ে আসতে হলে সালাম এর ডাক পড়ে এই জন্য। অবশ্য টাকা ও কম পায়না। প্রতিটা লাশ টানার জন্য ৬০০ টাকা পায় সে। এ দিয়ে সপ্তাহ খানেকের নেশার টাকা হয়ে যায়- ভাবতে ভাবতে আরেকটা গাঁজা ভরা সিগারেট ধরাল সালাম। সে মর্গের বাইরে অপেক্ষা করছে রমেশের জন্য। রমেশ আসলেই ওকে লাশ বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাবে সে।

নিশুতি রাতে বের হলেই এক বোতল বাংলা নিয়ে যায় সালাম সবখানে । এভাবে প্রায় সময় ওকে মর্গের বাইরে বসে থাকতে হয়। সরকারী চাকরি করে রমেশ।তাই কোন সময় আসে সেটার কোন ঠিক থাকেনা। আর লাশ ফেলে রেখে ও যাবার উপায় নেই। রমেশের হাতের আঙ্গুলের ছাপ একটা সরকারী কাগজে নিতে হয় ওকে।এই ছাপের জন্য ই বসে থাকে প্রায় সময়। এই অপেক্ষার সময় টা বাংলা খেয়ে কাটায়। পাঁচ দিন আগে একটা লাশ নিয়ে এসেছিল সে। সেই সময় বেশ টাকা পেয়েছিল। তাই আজকে সাথে গাঁজার পুরিয়া ও আছে।তাই সময়টা মন্দ কাটছে না। মর্গের বাইরে টুল পাতা আছে- সেই টুলে বসে বসে আরেকটা বিড়ি ধরাল সালাম।

গাঁজা খাবার অভ্যাস সেই ছোট বেলা থেকেই ছিল সালামের। একসময় গাঁজা বিক্রি করত রেললাইনের বস্তি তে। সেখান থেকে চলে আসে পনের বছর বয়সে। সেই থেকে ভ্যান চালায় সালাম। এই পেশায় খুব একটা টাকা আসেনা দেখে থানার দারোগা বাবুর হাতে পায়ে ধরে চার বছর আগে লাশ টানার কাজ টা পেয়েছিল। সেই থেকে কপাল খুলেছে সালামের। দুই বছর আগে বিয়ে ও করেছিল। কিন্তু সংসার টেকেনি। ওর বউ ফুলবানু নাকি রাতের বেলা ওর শরীরে লাশের পঁচা গন্ধ পায়। মাস তিনেক আগে তাই তালাক দিয়ে চলে গেছে আরেকটা লোকের সাথে। ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সালাম। অনেকবার চেয়েছিল এই পেশা ছেড়ে দেবে। কিন্তু পারেনি। পেটের দায়ে এখন ও এই পেশায় পড়ে আছে।

বৃষ্টি থেমে গেছে একটু আগে। এখন মাটিতে সোঁদা গন্ধ- সাথে সালামের গাঁজার ফ্যাকাসে গন্ধ মিলে একটা অন্য রকম পরিবেশ তৈরি করেছে মর্গের আশ পাশে। এর মাঝে বাংলার বোতল ও প্রায় শেষ করে ফেলেছে- এমন সময় হটাত করেই ওর সামনে এসে হাজির হল রমেশ ডোম। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। কিন্তু এখন ও শরীরে প্রচণ্ড শক্তি। আর এই বয়সে ও দিব্যি মাল খেয়ে বেড়ায় সে। সারাদিন ঘুমায়- রাতে এসে লাশ কাটাকাটি করে। সালামের সামনে এসে দাঁড়াতেই সালাম চমকে ঊঠে বলল-

“কে গো? রমেশ কাকা নাকি?”
অনেক ক্ষন চুপচাপ থেকে হো হো করে হেসে ফেলল রমেশ। কিন্তু অন্ধকারে সেই হাসি শুনে হটাত করে যেন ভয় পেয়ে গেল সালাম। বলল-

” কি গো রমেশ কাকা? এমুন করি হাস কেন?”

” কিছু না রে সালামইয়া- দেখলাম তুই কতটা ডরাস রাইতে” বলেই আবার হাসি শুরু করে দিল রমেশ।

রেগে গেল সালাম- ” হ- আমিই ডরাই- আর তুমি যে আমারে এতক্ষন বসায়া রাখলা- এই লাশ ঘরের সামনে বইতে বইতে আমার পা দুইখান শেষ হই গেল। এতক্ষন যে তুমি বৃষ্টিরে ডরাই লা?? ”

” না রে সালাম- আমার ঘর থেইকে বের হইতে দের হই গেছে। ভাবলাম থানা থেকে লাশ আসিছে- তোকে বসায়া রাখুম না- কিন্তু হটাত বৃষ্টি শুরু হইল- কি করুম- আমার কাছে তো ছাতি নাই- তাই বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত আমি বাইর হইলাম না। ”

সালাম তাকিয়ে দেখল রমেশের শরীর শুকনা। তবে সে একটা সাদা কাপড় লুঙ্গির মত পড়ে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি- সাথে খালি গায়ে সাদা লুঙ্গি পরিহিত রমেশ কে দেখে খানিক্টা ভয় পেল সালাম। বলল-
” দাও গো কাকা- কাগজ টাতে একখান টিপ মাইরা- আমি চলি যাই- বেশ রাইত হইসে। ঘরে যামু।” বলে পকেট থেকে কাগজ বের করে এগিয়ে দিল রমেশের দিকে।

কিন্তু রমেশ যেন দেখে ও দেখল না- বলল-

” তা তো যাইবাই- কিন্তু আজকা তোমারে ছাড়ুম না চান্দু- তোমারে আমার লাশ কাঁটা দেখামু “- বলে আবার হো হো করে হেসে ফেলল রমেশ।

” না না- আমার কোন স্বাদ নাই দেখনের। তুমি কাট তোমার লাশ- আমারে টিপ দাও- আমি যাইগা-” বলেই ঊঠে পড়তে চাইল সালাম- কিন্তু রমেশ সালামের বাম হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে গেল লাশ কাঁটা ঘরের সামনে। কোমড় থেকে চাবি বের করে খুলে ফেলল দরজা। তারপর চাবির গোছাটা ভেতরে রেখে ভ্যান এর সামনে নিয়ে আসল সালাম কে- বলল-

” নাও বাছা ধর তো- নিয়া যাই ভেতরে-”

সালাম না করল না। দুইজনে মিলে মেয়েটার লাশটাকে তুলে নিয়ে গেল লাশঘরের ভেতরে। সেখানে একটা সাদা কাপড় পাতা টেবিলের উপর লাশটা রেখে বাতি জ্বালিয়ে দিল রমেশ ডোম। তারপর হেটে গিয়ে একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাতি জ্বালিয়ে দিল। এই আলোতে অন্ধকার যেন আরো বেশী চেপে বসল। আশে পাশে কিছু দেখা যায়না। কোত্থেকে একটা বাক্স নিয়ে হাজির হল রমেশ। সেটা খুলে বের করল একটা ধারাল ছুড়ি। সেটা দিয়ে লাশ বাধার পাটি র বাঁধন খুলতে খুলতে বলল-

“আইজকে তোমারে আমি লাশ কাটা দেখামু। কোন দিন দেখলা না কিভাবে কাটি আমি লাশ” বলে হাসি হাসি মুখে তাকাল । হাসিটা দেখে হটাত ভয় পেয়ে গেল সালাম। কেমন যেন একটা জড়তা চলে এল ওর মাঝে। মন্ত্রমুগ্ধের মত মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপর দেখতে লাগল কি করে রমেশ। অদ্ভুত এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে চারপাশে। এই অন্ধকার রাতে স্যাঁত স্যাঁতে সোঁদা গন্ধের সাথে একটা পঁচা পঁচা গন্ধে ভরে গেল সারা ঘড়। কিন্তু সালামের কোন অনুভুতি কাজ করছে না। সে তাকিয়ে আছে রমেশের সামনে রাখা লাশের দিকে। গন্ধের উৎস হয়ত সেখানেই।

রমেশ আস্তে আস্তে চারটা দড়ি কেটে লাশের উপর থেকে পাটি সরিয়ে ফেলল। তারপর সেই লাশের উপর থেকে সাদা কাফনের কাপড় টা সরিয়ে দিল। বাঁধন খুলতে গিয়ে সালাম ও হাত লাগাল। উপরের দিকের কাপড়টা খুলে সালাম দেখল এক অনিন্দ্য সুন্দরীর মুখ- এখন ফুলে ফেপে ঢোল হয়ে আছে। চোখের নিচে আর নাকের ফুটো দিয়ে চাপ চাপ রক্ত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সালাম বলল-

” আহা কত সোন্দর আছিল- এখন কেউ এরে ছুইতে ও চাইব না- একদিন নিশ্চয় সবাই এই মায়ারে পাইতে চাইত- নিজের বউ বানাইতে চাইত- আইজকে সেই লোক গুলান আর এই মায়াটারে স্বপ্নে ও পাইতে চাইব না- কি আজিব দুনিয়া না রমেশ কাকা?”

খেক খেক করে হেসে রমেশ বলল-
“আরে দুই পয়সার দাম নাই জিনিস দিয়ে মানুষ কত ভাব ধরে দেখস না? এই মাংস এখন কাউরে দিলে ও নিবনা- কিন্তু ফুটানি মারে সব সময় এই মাংস নিয়া- দুনিয়া ছাইড়া গেলে সবাই ছুইতে ডরায়- দুনিয়ার মাঝে যারা ভালবাসে তারাও এই লাশ দেইখে ডরায়”- বলে আবার হাসি শুরু করল।

মনটা খারাপ হয়ে গেল সালামের। রমেশের খিস্তি হাসি শুনে আরো বেশী মন খারাপ হল। আজকে যেন বেশী বেশী হাসছে রমেশ। বেশী নেশা করলে যা হয় আরকি। ওকে টিপ না দিয়ে এই লাশ ঘড়ে আটকে রেখেছে। মাতালের সাথে বেশী কথা বলল না সালাম। এক নজরে দেখতে লাগল রমেশ কি করে।

রমেশ একটা ধারাল কাচি দিয়ে মেয়েটার উন্মুক্ত শরীরে বুক এর মাঝখান থেকে ধরে একটানে সোজা কেটে ফেলল নাভি পর্যন্ত। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত পড়া। কোত্থেকে এক গ্লাস পানি এনে ঢেলে দিল সেই রক্তের উপর। সাথে সাথে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল অনেক রক্ত। জীবন্ত মানুষের অপারেশন করতে অনেক কষ্ট- কিন্তু মরা লাশের অপারেশন করা অনেক সহজ। এরপর সেই লাশের দুইদিকে সুই দিয়ে চামড়া টান টান করে ট্রের সাথে লাগিয়ে দিয়ে কাটা শুরু করল লাশের বিভিন্ন অংগ প্রত্যঙ্গ। লাশের শরীর ফোলার কারন বুঝা গেল এবার। মেয়েটা অনেক মোটা ছিল- সারা শরীরে ভর্তি চর্বি। এই চর্বি গুলো হলদে আকার ধারন করেছে মরার পর। সেই চর্বি গুলো কেটে কেটে একটা বালতিতে ফেলে দিল রমেশ। অনেক দিনের অভ্যস্ত হাতে একটা একটা করে অংগ প্রত্যঙ্গ কাটছে রমেশ খালি হাতে- আর একটা ওজন যন্ত্রের উপর রেখে রেখে ওজন নিচ্ছে। তারপর টেবিলের আরেকপাশে সেই অংগ গুলো রেখে দিচ্ছে সাজিয়ে। হা করে তাকিয়ে আছে সালাম। কোন দিন লাশ কাঁটা দেখেনি। আজকে দেখছে- কিন্তু খেয়াল করেনি কখন পায়ের কাছে একটা কুকুর এসে পড়েছে- হটাত পায়ে একটা হালকা ছোয়া পেতেই ভয় পেয়ে গেল সালাম- তারপর টেবিলের নিচে তাকিয়ে দেখল রমেশের কুকুর ভুতু। সে টেবিলের তলায় রাখা বালতি থেকে মুখ দিয়ে কি যেন খাচ্ছে। হটাত মনে পড়ল সালামের-এই বালতিতেই লাশের চর্বি গুলো রেখেছিল রমেশ। উপরে উঠে রমেশ কে সেটা বলতে যেতেই দেখল রমেশ হাসি মুখে তাকিয়ে তাকিয়ে বলল-

” আরে এই জিনিসটা ভুতুর অনেক প্রিয়। ওরে ভাল কিছু তো খাইতে দিতে পারিনা- তাই এখানে আসলে ও হলুদ জিনিসটা খায়। ওরে আগে বকা দিতাম- কিন্তু চিন্তা করলাম – ভুতুরে ভাল মন্দ কিছু খাইতে দিতে পারিনা- কুকুরটা যখন এই জিনিসটা পছন্দ করছে- তাইলে কি হয় খাইলে একটু-” বলে আবার হেসে ফেলল রমেশ।

এবার কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠল সালামের। খেতে দিতে হলে ময়লা খাবে- তাই বলে মানুষের চর্বি খাবে একটা পোষা কুকুর? নাক মুখ কুঁচকে আবার নিচে দেখে নিল সালাম। কুকুরটা তখন ও খেয়ে চলেছে চর্বি।

আস্তে আস্তে কাজ করে চলেছে রমেশ। সব অংগ প্রত্যঙ্গ প্রায় কাটা শেষ এমন সময় কি যেন চিন্তা করে কাজ থামিয়ে দিল সে। তারপর একটা একটা অংগ আবার যথা স্থানে রেখে দিতে লাগল। শুধু কলিজাটা পড়ে আছে টেবিলের এক কোনায়। কালচে আকার ধারন করেছে সেটা। হটাত কি মনে করে কলিজাটা একটা পলিথিন ব্যাগে পেচিয়ে নিয়ে হাটা দিল রমেশ। অবাক হয়ে গেল সালাম। অবাক হয়েই জিজ্ঞাস করল-

“কই যাও কাকা? কইলজাটা কই নিয়া যাও তুমি? কি করবা এটা দিয়া?”

পেছন ফিরে তাকাল রমেশ- খুব একটা ভাল ভাবে চেহারা দেখা যাচ্ছেনা- দেখা যাচ্ছে শুধু হলদে দাঁতের পাটি। হেসে হেসে ই বলল রমেশ-

” এইত- এই কইলজাটার একটা ব্যাবস্থা কইরা আসি রে সালাম- তুই থাক- আমি অক্ষন ই আইতাসি- এই যামু আর আসমু- সামান্য সময় থাক তুই” বলেই হন হন করে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে গেল রমেশ। পেছন পেছন কুকুরটা ও ছিল। কি মনে করে পেছন ফিরে তাকাল কুকুরটা- অন্ধকারে কুকুরটার হলদে চোখের মনি দেখে ভয় পেয়ে গেল সালাম। একটু পরেই আবার বের হয়ে গেল সেটা। হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল সালাম। লুঙ্গির গিট্টু থেকে একটা গাঁজার পুরিয়া বের করে টানা শুরু করতেই হটাত চিৎকার চেচামেচি শুনতে পেল সালাম- লাশ ঘরের বাইরে থেকে কারা যেন কথা বলে কিছু বুঝতে চাইছে। কেউ একজন মহিলা কাঁদছে। তাড়াতাড়ি লাশ ঘর থেকে বের হয়ে আসল সালাম। দরজা খুলে বের হয়েই অবাক হয়ে গেল সালাম। বাইরে আরেকটা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। সালামের ভ্যানটা সরানো নিয়ে তর্ক করছিল কিছু মানূষ। মনে হচ্ছে ভ্যানে করে কোন একটা লাশ নিয়ে এসেছে কেউ। সাথে সেই লাশের আত্মীয় স্বজন। তাদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল ভেতর থেকে।

সালাম বের হয়েই জিজ্ঞাস করল-
” কি হইসে ভাই- কার লাশ নিয়া আসিছেন? রমেশ তো একটু আগে বাইর হইল- এখন ই আসি যাবে “- বলে গাঁজায় শেষ টান দিয়ে ফেলে দিল ফিল্টার টা।

হটাত নিস্তব্ধ হয়ে গেল সামনের জনতা।ভোর হতে শুরু করেছে মাত্র। আস্তে আস্তে জেগে উঠতে শুরু করেছে পাখি গুলো। এমন সময় যেন একটা বোমা ফাটাল সালাম। সামনে থাকা সবাই ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। একজন মহিলা এগিয়ে সালাম কে বলল-
” কে আছিল এতক্ষন? কে আছিল ভেতরে?”

“ক্যান কইলাম না রমেশ কাকা বাইরে গেছে- একটু পরেই আইসে পড়বে”
বিরক্তি সুরে বলল সালাম।

সেই মহিলা হটাত গিয়ে ভ্যানে রাখা লাশটার মুখ থেকে কাপড় খুলে ফেলে বলল-
” রমেশ যদি এখানে আসে- তবে এইটা কেডা?”

লাশে মাথাটা দেখে হটাত মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল সালামের। রমেশ সাদা কাপড় এ বাঁধা লাশ হয়ে পড়ে আছে সালামের সামনের ভ্যানে। হটাত করে বুঝতে পারল সালাম- ও অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। শুধু অজ্ঞান হবার আগে সেই ভ্যানের পাশে দাঁড়ানো রমেশের কুকুরটাকে দেখতে পেল সে। সেই হলদে চোখে তাকিয়ে আছে খানিক ক্ষন আগের মত। মুখের পাশে লেগে আছে হলদে চর্বি ।।

Related posts