বীভৎস সেই রাতে !!

Photo: আমি রাহাত, থাকি পুরান ঢাকার বেচারাম দেউরিতে।। আজ আপনাদের সাথে একটি ছোট ঘটনা শেয়ার করবো।। এর কোনও বিশ্লেষণ আমি এখনো পর্যন্ত পাই নি।। আপনাদের কাছে জিজ্ঞাসা থাকবে, যদি আপনারা কোনও উত্তর দিতে পারেন তাহলে প্লিজ জানাবেন।।

আমার রুমের জানালাটা ঠিক পাশের এক বিল্ডিং এর গা ঘেঁষে।। আগে যখন বি এন পি সরকার ছিল তখন এই বাড়ির ছাদে এনে অনেক লোককে পিটানো হয়েছে।। অনেকেই বলে এমনকি খুনও নাকি হয়েছে।। যাই হোক, আমার জানলায় প্রায় রাতেই কে যেনও ঠক ঠক করতো।। আনুমানিক রাত ৩ টার দিকে আওয়াজটা পাওয়া যেতো।। আমার প্রতিদিন ঘুম ভাঙত না, তবে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি সাংঘাতিক ভয় পেতাম।। আমার কথা বিশ্বাস না হওয়ায় আমার বড় ভাই নিজেও প্রায় ২ মাস একসাথে আমার বিছানায় থাকতো।। সেইসময়ও আওয়াজটা হতো।। এবং আমরা দুজনেই আওয়াজটা পেতাম।। কোনোদিন খুলে দেখার সাহস হয় নি তখনো।। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যকর ব্যাপার হল, আওয়াজটা ঠিক রাতে ৩টার পর পর হতো এবং ১৫ মিনিট পর থেমে যেতো।।

অবস্থা বেগতিক দেখে আমার মা উনার ছোট ভাইকে খবর দেন।। অর্থাৎ আমার ছোট মামা।। এখানে বলে রাখা ভালো, আমরা কয়েকবার কে কে বলে চিৎকার করেছি, কিন্তু কোনও সাড়া শব্দ পাইনি।। তাই পাছে কোনও ক্ষতি হয় এই ভয়ে আমরা জানালা খুলতাম না।। আর আমার বাবা প্রায় সময়েই বাড়ির বাইরে থাকতেন।। শুধু বাড়িতে আমি, মা, আর আমার ভাই।। একা বাড়িতে এমন রিস্ক নিয়ে রাতের বেলা জানালা খোলার সাহস কারো ছিল না।।

সে যাই হোক, আমার ছোট মামা আসার পর উনাকে আমার সাথে থাকতে দেয়া হল।। সেদিন রাতে আমরা খাওয়া দাওয়া করে ৩টার দিকে ঘুমিয়ে পড়ি।। আমার কিছুতেই ঘুম আসছিলো না।। ছোট মামা নিজে খুবই সাহসী লোক।। উনাকে বলা হয়েছিলো জানালা নক করার ব্যাপারে।। কিন্তু উনি হেসে উড়িয়ে দেন।। যাই হোক, রাত ৩ টার দিকে কোনও এক কারণে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।। অনুভব করি সাড়া গা ঘামে ভিজে গেছে।। মনে হয় কারেন্ট নেই।। আমি ধাক্কা দিয়ে মামাকে দেখার চেষ্টা করি।। কিন্তু মামা পাশে নেই।। আমার বুকটা ধক করে উঠে।। মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে দেখি রাত তখন ৩ টা বেজে ১৫ মিনিট।। আমি খুব ভয়ে এবং সাবধানে আমার বিছানা থেকে নেমে যাই।। রুম থেকে বের হতেই দেখি মামা আমাদের খাবার রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।। এই জানালা থেকে আমার রুমের পাশের ছাদটা পরিষ্কার দেখা যায়।। দেখলাম মামা গভীর মনোযোগে কি যেনও দেখছেন।। আমি পা টিপে টিপে মামার পাশে এসে দাঁড়াই।। মামা আমাকে দেখে চমকে গেলেন।। আমি বুঝলাম না আমাকে দেখে মামা চমকালেন কেন।। মামা আমাকে ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলেন এবং বললেন উঁকি না দিতে।। কিন্তু ততক্ষণে আমি দেখে ফেলেছি যা দেখার।।

সেই ছাদে একটা লাশ পরে আছে।। জবাই করা একটা লাশ।। মাথাটা ধর থেকে আলাদা করা।। চাঁদের আলোর দেখা যাচ্ছে ছাদটা রক্তে ভিজে একাকার হয়ে গেছে।। কিন্তু এর চেয়েও ভৌতিক যেই ব্যাপারটা ছিল যে, আমার জানালার পাশে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।। লোকটা সাদা কাপড় পরিহিত।। হাতে একটা লাঠি দিয়ে আমার জানালায় আওয়াজ করছেন।। ঠকঠক ঠকঠক।। কিছুক্ষণ থেমে আবার ঠকঠক।। আমি লোকটার আগা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করলাম।। এই এলাকায় আমরা আছি আমার জন্মের পর থেকে।। এলাকার প্রায় সবাইকেই আমি চিনি।। যদিয়ও উনার চেহারা দেখতে পাচ্ছিলাম না।। তবে এতো লম্বা এবং দীর্ঘকায় মানুষ আমাদের এলাকায় নেই তা আমি লিখে দিতে পারবো।। যে ব্যাপারটা আরও বেশি আমাদের ধাঁধায় গেলে দিলো, তা হল, ঠিক ১০ মিনিট পর সেই লোকটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।। এবং প্রায় সাথে সাথেই লাশটা।। মামা ঘোর লাগা গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “লাশটা এবং লোকটা কই গেলো?? কিছু বুঝলাম না।। তুই কি যেতে দেখেছিস??”

আমি মাথা নাড়লাম।।

ঠিক ৩ দিন পর আমরা বাড়িটা ছেড়ে দেই।। ছেড়ে দিয়ে নতুন বাড়িতে উঠি।। এরপর খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, ঐ বারিরি ছাদে নাকি অনেক মানুষকেই এনে মেরে ফেলা হয়।। কাউকে জবাই করে, কাউকে ছুড়ি, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে।। অনেক লাশই নাকি ছাদের পাশেই ফেলে রেখে দেয়া হয় দীর্ঘকাল।। এরপর মাটি চাপা দেয়া হয় কোনও জানাজা ছাড়া।। অনেকেরই ধারণা এগুলো সেই অভিশপ্ত আত্মা।।

সেই বাড়ির নতুন ভাড়াটিয়ার একটা মেয়ে ২ মাস পর গলায় ফাস নিয়ে মারা যায়।। মেয়েটা আমার রুমেই থাকতো, অর্থাৎ ছাদের পাশের রুমটায়।।

এই ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।। আর ব্যাপারটা যেহেতু মামা নিজেও দেখেছেন এবং আমরা কেউ কাউকে বর্ণনা করি নি, কিন্তু একই সময়ে একই জিনিস দেখেছি, তাই আমি একে হালুসিনেসনও বলতে পারছি না।।

প্লিজ কেউ বাজে কিছু বলবেন না।। এটি আমার জীবনের একটি সত্য ঘটনা।। আপনাদের কাছে এর ব্যাখ্যা চাইবো বলে শেয়ার করলাম।।

যিনি পাঠিয়েছেনঃ Mirza Benazir Rahat

লাইক ও কমেন্ট দিয়ে আপনার মতামত জানান ।

এস.এস.সি পরিক্ষা শেষ। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না? একদিন আম্মা বলল চল সইয়ের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে আসি। আমি, আম্মা, বদরুল, হাদীমামা সবাই মিলে কিশোরগন্জের পাকুন্দিয়া আম্মার সইয়ের বাড়ী বেড়াতে গেলাম। হৈ হৈ রৈ রৈ করে দিনগুলো খুব ভালই কাটছে। এর মাঝে একদিন ঐ এলাকায় মাইকে প্রচার হচ্ছে যাত্রা হবে।আমরা খুবই উৎফুল্ল। রাত্রে আমি, মামা, নয়ন ভাই, স্বপন, শরিফ, আরও তিনজন মিলে রওনা হলাম। মোটামুটি তিন কি.মি. রাস্তা। তার মাঝে নাকি আবার নদী পার হইতে হয়।

প্রচন্ড শীত। খোলা গলায় গান ছেড়ে নদীর পাড় দিয়ে চলছি। পাশের ঘন কাশবন ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে একজোড়া…দুই জোড়া চোখ এসে উকি দেয়। উকি দিয়েই শেয়াল গুলো পাশের ঝোপে হারিয়ে যায়। মামা বলল শেয়ালেরা রাত্রে নদীর পাড়ে আসে কাকড়া খাওয়ার জন্য।

আমরা মূল নদীরঘাটে এসে পৌছালাম। দেখি মাঝি নাই কিন্তু নৌকা আছে। আমরা মাঝিকে ডাকাডাকি করতে লাগলে কিছুক্ষণ পর মাঝিকে দেখলাম কাশবন থেকে বেড়িয়ে আসল। কিছুটা অপৃকতস্থ কি লেগেছিল? মনে নাই। নদী পার হলাম। আরও এক কিলোমিটার।

এবার কিন্তু সোজা কাশবনের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। ছোট একটা রাস্তা। বোঝাই যাচ্ছে এটা একটা কাশবনই ছিল। মানুষ হাটতে হাটতে কিছুটা রাস্তা হয়েছে। হালকা চাদনী। দুইধারের কাশের জন্য দু্ইপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। শুধু সামনে আর পিছনে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সামনে আর পিছনের দুইপাশে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। কেননা চাদের আলো এতনিচে এসে পৌছাচ্ছেনা। আমরা সবাই হাটছি তো হাটছিই। কুয়াশা পরে দুইপাশের কাশগুলো কিছুটা নুয়ে পড়েছে। ফলে হাটার সময় আমাদের মুখে এসে লাগছে। খুবই বিরক্তিকর একটা ব্যাপার।

অনেকক্ষণ যাবৎ আমি একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম যে কিছুক্ষণ পর পরই কাশবনের ভিতর একটা শব্দ হচ্ছে। শেষবার যখন শব্দটা শুনলাম তখন আমার মনে হলো কিছু একটা আমাদের সাথে সাথে চলছে। আর কিছুক্ষণ পরপর শব্দটা শুনিয়ে কি বুঝাতে চাচ্ছে বুঝলাম না। তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর একই শব্দটা শোনা যাচ্ছে। বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে করে সামনে যাওয়ার যে শব্দটা ঠিক সেই রকম। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।তবে কারও কাছে কিছু বললাম না।
সোজা সামনে হাটছি।

থেকে থেকে শব্দটা আমি ঠিকই শুনতে পাচ্ছি। একটা জিনিস খুব অদ্ভুত লাগছিল যে সবাই কেমন জানি নির্বিকার, কেউ কি কিছু শুনতে পাচ্ছেনা। তাহলে আমি কি কোন হ্যালুসেশানে আছি। মানুষের চেচামেচি শোনা যাচ্ছে। আমি আর মামাছাড়া আর বাকি সবাই দেখি দৌড় দিল। আমরাও পিছনে পিছনে দৌড় লাগালাম।

মোটামুটি সামনেই বসলাম। সবাই চিৎকার-চেচামেচি করছে। দুইঘন্টা……… এরমাঝে আয়োজকদের একজন এসে বলে গেল চুপ করার জন্য এখনি নাকি যাত্রা শুরু হবে। ৫-১০ সেকেন্ড চুপ ছিল আবার চিল্লা-চিল্লি। এবার স্থানীয় চেয়ারম্যানের অনুরোধ। সবাই চুপ।

নুপুরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বাদ্যযন্ত্র বেজে উঠল। নাচ শুরু হবে মনে হচ্ছে।সে কি নাচ……..নাচের তালে তালে দর্শকরা সবাই উন্মাতাল। মামার দিকে তাকিয়ে দেখি বসে বসে লাফাচ্ছে। মামা আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা লজ্জা পেল। কেউ কেউ টাকাও ছুড়ে মারছে। নৃত্যশিল্পী টাকা কুড়িয়ে ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বুকে রাখছে আর গা থেকে ধীরে ধীরে কাপড় খুলে ফেলছে। মামাকে দেখি বসা থেকে দাড়িয়ে দাড়িয়ে লাফাচ্ছে। এদিকে দর্শক সারি থেকে একলোক লাফ দিয়ে মঞ্চে উঠে নৃত্যশিল্পীর বুকে হাত দিলো। শিল্পী কিছুটা বিব্রত বোঝাই যাচ্ছে।

স্বেচ্ছা সেবকদের আট-দশজন মিলে একটা লোককে ধরে নিয়ে গেল। আয়োজককারীদের মধ্য থেকে একজন এসে অনুরোধ করে যাচ্ছে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে। অহেতুক ঝামেলা কার সহ্য হয়? হঠাৎ একজন ওই লোককে মাইর শুরু করল। সাথে সাথে দর্শকরাও ঝাপিয়ে পড়ল। মুহুর্তের মাঝেই হাজার হাজার মানুষ দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। শরীফ, স্বপন বলল মামা দৌড় দেন… বিরাট মাইর লাগব…….এই এলাকা খুব খারাপ।
আমরা দৌড় লাগালাম।

শরীফ, স্বপনরা সামনে দিয়া আমরা পিছনে। দৌড়াচ্ছিতো… দৌড়াচ্ছিতো… পিছন দিয়া ধর ধর….। জইল্যারে ছাড়িসনা………মজিত্যা কই? এরকম হাজারও চিৎকার কানে ভেসে আসছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি হাজারও মানুষ দ্বিক-বেদ্বিক হয়ে দৌড়াচ্ছে। আমরা তখন রাস্তা ছেড়ে কাশবনের ভিতর দিয়া হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে আগাচ্ছি। মামার জুতা ছিড়ে গেছে। বেচারা ঐ জায়গায় বসে জুতার জন্য শোক করা শুরু করল। মামা আবার ভীষন কৃপণতো। আমরা মামাকে ধরে টেনে হিচড়ে ভিতরে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে ধর ধর আওয়াজটাও স্তিমিত হয়ে আসছে।

আমরা নদীরপাড়ে এসে দাড়ালাম। হালকা চাদনি। ঘাটে কেউ নেই। সহজেই বুঝতে পারলাম ভয়ে কেউ এদিকটায় আসেনি। শরিফ বলল এখানে দাড়ানো মোটেও নিরাপদ নয়। যে কোন ভাবেই নদীপাড় হতে হবে। আমি আবার সাঁতার জানিনা। মামা বলল ভাগ্নে তুমি আমার কাধে উঠ। আমি রাজি হলামনা। আমি সারাজীবন সব জায়গায় মাতব্বরি করতাম শুধু পানি ছাড়া। কেননা হাজার চেষ্টা করেও যে সাতারটা শিকতে পারলামনা। আমার সবসময় ভয় বেশী পানিতে গেলে নিচ দিয়ে যদি কেউ টান দেয়। সবাই আমাকে অনেক বুঝানোর পরও রাজি হলাম না। সবাই নদীর পাড়ে দাড়িয়ে আছি। একটা অজানা আতংক সবার ভিতরে কাজ করছে।

আল্লাহু… আল্লাহু… সবাই একটু ছড়ানো-ছিটানো থাকলেও দেখলাম মুহুর্ত্তের মাঝে একসাথে জড়ো হয়ে গেল। শব্দটার উৎপত্তি বুঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। এর মাঝে শুনলাম ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…. কাশবনের ভিতর দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সে দিকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা কাশবনের উপরদিয়ে দেখা যাচ্ছে। আমরা সবাই সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। আলোর তীব্রতা এবং শব্দের তীব্রতা বেড়েই চলছে।

সবাই একদৃষ্টিতে ঐ দিকে তাকিয়ে আছি। দেখি দুইজন মানুষ ঐ কাশবনের পথ দিয়ে বের হয়ে আসছে। দুইজনের হাতে দুইটি হারিকেন। পিছনে চারজনে কাদে করে একটি খাটিয়া নিয়ে আসলো। সাদা কাপড়ে ঢাকা। বুঝলাম কোন লাশ নিয়ে এসেছে। তার পিছনে আরও দুইজন হারিকেন হাতে। অবাক হয়ে গেলাম।

আসসালামু ওয়ালাইকুম। সবাই সালামের জবাব দিলাম।সবার চোখে-মুখে উৎকন্ঠা স্পষ্ট। আমি একটু আগ বাড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার বলুনতো। সবচেয়ে বৃদ্ধ যে লোকটা সে বলল “মৃত ব্যাক্তিটি হলো এই এলাকার জামাই। শ্বশুর বাড়ীতে এসেছিল। সাপের কামড়ে সন্ধায় মৃত্যু হয়েছে। এখন ঐ পাড়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে দাফনের জন্য।” সবার জড়তা মনে হয় একটু কাটল।

-বাবা নৌকা নাই
-না চাচা দেখি না তো
-ঠিক আছে তাহলে আপনারা এইখানে লাশের পাশে দাড়ান আমরা গিয়ে নৌকা নিয়ে আসছি।

এইটা কি কয়? মাথাটা আবার ঝিনঝিন করে উঠল। একটু সন্দেহও লাগছিল। শেষে আমি বললাম আপনারা চারজন এবং আমর চারজন মিলে গিয়ে নৌকা নিয়ে আসব। আর বাকি সবাই এখানে থাকুক।চাচা মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারল। চাচার মুখে যে হাসিটা দেখলাম সেই হাসির রহস্য হাজার রকমের হতে পারে।

আমরা আটজন মিলে রওনা হলাম। নদীর পাড়ে ধরে হাটছি। সাথে দুইটি হারিকেন। চাচা মনে হয় মাঝির বাড়ি চিনে।সেই দেখলাম চিনিয়ে চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটা জায়গায় এসে চাচা থামল। টর্চলাইট মেরে দেখলাম ঘাটে ঐ বিশাল নৌকাটা বাধা আছে। জায়গাটা অনেক অন্ধকার। নদীর পাড়ের উপরে বাড়ি ঘরও আছে। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুপুরী। কিছুটা ভয় ভয় লাগছে। একটা প্যাচা উড়ে গেল।পানিতে কিছু পড়ার শব্দ। ঐ হাইল্যা… হাইল্যারে…….. বুঝতে পারলাম মাঝির নাম হালিম। কোন সারাশব্দ নাই। চাচা রাগে বলতে লাগল সবাই কি মইরা ভূত হয়ে গেছে। শেষে আমরাই নৌকা নিয়ে আসলাম।

অনেক বড় নৌকা। নৌকার ছাদ নেই। উপরে কাঠ দিয়ে মেঝে করা হয়েছে। তবে মাঝখানে চার হাতের মত জায়গা ফাকা। পানি সেচের সুবিধার জন্য এটা করা হয়। আমরা এই ফাকের এক পাশে বসলাম। অন্য পাশে ওরা। আমি নৌকার শেষ মাথায় বসলাম। নৌকা যখন ছাড়বে, ঠিক তখনি কাশবনের ভিতর থেকে একটা আওয়াজ আসল।

-বাবারা আমারে একটু নিয়া যাও।

টর্চ লাইট মেরে দেখি এক বৃদ্ধলোক। ভাবলাম এতরাত্রে আমরা নিয়া না গেলে বেচারা কিভাবে পার হবে? তাই আমিই সবাইকে অনুরোধ করলাম নেওয়ার জন্য। নৌকাটি ভাসিয়ে লোকটি লাফ দিয়ে নৌকায় উঠল। নৌকাটি দোলনার মত দোল খেতে লাগল। আমার কাছে মনে হলো সবাই নৌকায় উঠার পর নৌকাটি যতটুকু ডুবল ঐ লোকটি উঠার পর আরও বেশী ডুবল। লোকটি লাশের ঠিক পায়ের কাছে বসল। নৌকা চলতে লাগল।

খুব বেশী বড় নদী না। কিছুটা স্রোত আছে। মনের ভিতর অজানা আশংকটা যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করছি ততই মনে পড়ছে। এই হালকা চাদনী রাতে কাশবনের উপরে কুয়াশার ধোয়া যে মায়াবী জাল সৃষ্টি করেছে তা আলিফ লায়লার কথা মনে করিয়ে দিল। ভয় কাটানোর জন্য মনে মনে গান গাওয়ার চেষ্টা করলাম। জোরকরেই কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যেতে চাইলাম। দূরে ভেসে যাওয়া কলাগাছরুপী লাশগুলোকে একমনে দেখছিলাম।

হঠাৎ যে নৌকা চালাচ্ছিল তার বিকট চিৎকার। কেউ একজন পানিতে ঝাপিয়ে পড়ার শব্দ। আমি ঘুরে তাকাতে তাকাতেই সমস্ত নৌকাটা দুলে উঠল যেন কোন নীলদড়িয়ায় নৌকাটি ঝড়ের কবলে পড়েছে। সবাই লাফিয়ে পানিতে পড়ছে। মামা চিৎকার করে পানিতে লাফ দেওয়ার জন্য বলছে। আমি উঠে দাড়ালাম। নৌকার শেষমাথায় টর্চলাইট মেরে দেখি বৃদ্ধটি লাশের একটি পা ধরে পা‘র মাংস খাচ্ছে। পায়ের হারটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বৃদ্ধটির মুখে আলো পড়তেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখ থেকে নীলআলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। মুখে রক্তের দাগের মত এ্যাবরো-থেবরো মাংস লেপটানো। বিবৎস দৃশ্য। খুব বমি আসতে লাগল। আমি জোড়করে চেষ্টা করছি সবকিছু আটকিয়ে রাখতে। তীরের দিকে তাকালাম। বুঝতে পারছি এতটুকু সাঁতার দিয়ে পার হওয়া আমার পক্ষে সম্ভবনা। সবাইকে দেখলাম চিৎকার করছে আর দৌড়াচ্ছে। আমি বৃদ্ধের দিকে টর্চলাইট মেরে দাড়িয়ে রইলাম। বৃদ্ধটি আমার দিকে তাকালো…… উঠে দাড়ালো….. ঝপাৎ।

যতক্ষণ পারলাম সাঁতার কাটতেই থাকলাম। শেষে মাটি হাটুতে বাজল। বুঝতে পারলাম তীরে এসে পৌছেছি। দৌড় লাগালাম। চিৎকার অনুসরণ করে কাশবনের ভিতর দিয়ে দৌড়াতে লাগলাম। হাজার-হাজার মানুষের চিৎকার। চারদিকে মশাল আর মশাল। কেউ কেউ ডাকাত ডাকাত করেও চিল্লাচ্ছে। কাশবনের ঐ পাশেই একটা বাড়ী আছে সেখানে সবাই পরে রইলো। আমিও গিয়ে ঐ খানে শুয়ে পড়লাম। চারদিকে মানুষ ঘিরে ধরেছে। কেউ কেউ আমার কাছে ঘটনা জানতে চাইলো…. আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলনা। এর মাঝে একজন সবাইকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিল। সবার মাথায় পানি ঢালার ব্যাবস্থা করতে বলল। মামার হুশ হওয়ার পর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল- ভাইগ্না বাইচ্যা আছ? আপা আমারে মাইরাই ফালতো। একে একে সবাই হুশ হলো। আমি সব ঘটনা খুলে বললাম। এর মাঝে দেখি শরীফের আব্বাও লোক নিয়ে হাজির। কেউ কেউ নদীর পাড়ে যাওয়ার সাহস দেখালো। শেষে আমি সবাইকে নিয়া নদীর পাড়ে গেলাম। নৌকা নাই। আমরা স্রোতের অনুকুলে হেটে যাচ্ছি। সবাই চিৎকার করে উঠল এই যে নৌকা। দেখলাম শুধু কংকালটা আছে। এর মাঝে একজন বলল দেখিতো মাটিতে পায়ের দাগ আছে কিনা? আমরা নদীর পাড়ে কোন পায়ের দাগও পাইনি।
শেষে ঐ কংকালটিই মাটি দেওয়া হলো।

Related posts