ঘটনাটি বেশ কয়েক বছর আগের। এক জ্যোৎস্না রাতে আমি ও আমার দুই বন্ধু বাইরে থেকে খাবার কিনে ছাদে গিয়েছি খাবো একসাথে। আমরা ছাদে উঠার ঠিক কিছু সময় আগেই কারেন্ট চলে যায়। বলে রাখা ভাল আমি স্টাফ কোয়াটার এর বাসিন্দা। কারেন্ট বছরে তখন কয়বার যেত হাতে গুনে বলতে পারব। আমরা কেউই ভিতু প্রকৃতির ছিলাম না। ছাদে উঠেই মনে পড়ল খাবার খাওয়ার জন্য গ্লাস আর প্লেট দরকার। তো আমি নিচে নেমে গেলাম সাজ সর…ঞ্জাম আনার জন্য। ফিরে এসে দেখি আমার দুই বন্ধু ফিসফিস করে কথা বলছে। আমাকে দেখে বলল এত রাতে তোদের ছাদে কারা টাঙ্কি মারে রে! আমি তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই তো। একটি ছেলে আর মেয়ে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটার পরনে সালওয়ার কামিজ আর ছেলেটার টি-সার্ট। তিরিশ ফিট দূর থেকে স্পষ্ট চেহারা না দেখা গেলেও এতটুকু বুঝতে কোনই সমস্যা হচ্ছিলনা যে দুজন মানুষ আমাদের দেখে কিছুটা ইতস্তত বোধ করছে; খুবিই স্বাভাবিক ঘটনা দুজন কপোত কপোতী আমাদের দেখলে ওদের বিরক্তি লাগবেই। কিন্তু আমাদের বিল্ডিংএ সেরকম কেউ তখন ছিলনা এত রাতে ছাদে বসে টাঙ্কি মারবে। আমি খুবিই অবাক হলাম। আমার বন্ধুরা বলল ওরা নাকি কয়েকবার ওদের পাশ দিয়ে ঘুরে এসেছে চেনার জন্য কিন্তু আগে কখনও দেখেনি। আমি বললাম ঠিক আছে আমি দেখে আসি। আমি গেলাম ছাদের অপর পারে আর আমার বন্ধুদয় ছাঁদের গেট এর পাশে দাড়িয়ে রইল। আমি গিয়ে মানুষ কেন কোনও কিছুরই অস্তিত্ব পেলামনা। পকেট থেকে মোবাইল বের করে লাইট জ্বালিয়ে খুজে দেখলাম। কোথাও কোনও কিছু নেই; কোনও সাড়াশব্দ নেই। বেশ ঘাবড়ে গেলাম কারণ আমাদের বাসার পিছনে শুধু গাছপালা জঙ্গল ছাড়া আর কিছু ছিলনা। জীনের আবাস সেসব জায়গা আমরা তার আভাস বহুবার পেয়েছি। সেসব গল্প আরেকদিন বলব। মফস্বল শহরে জীনপরী বাস করবে আর সেটা যদি সিলেট হয় খুব একটা অস্বাভাবিক না। পাহাড় পর্বত আর চা বাগান ঘেরা এই শহরে ৩৬০ অলি আউলার আবাস ছিল একদিন। আমরা জীনপরীর গল্প প্রতি রাতে শুনে ঘুমাতে যেতাম সেই ছোটবেলা থেকেই। এখন শহর অনেক বড় হয়েছে কিন্তু তখন সবাই সবাইকে চিনত। মূল ঘটনা থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছি; প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, শ্বাস বন্ধ করে দৌড়ে গেটের সামনে এসে বন্ধুদের সব কথা খুলে বললাম। তারা প্রথমে আমার কথা বিশ্বাস করলনা, মনে করল মজা করছি। পরে ছাদের দরজা লাগিয়ে পুরো ছাঁদ তন্নতন্ন করে খুজে কাউকেই পেলাম না। পরে সবাই মুখে কলপ এঁটে আমাদের জান হাতে রেখে খাবার আর সব কিছু ছাদেই ফেলে নিচে নেমে এলাম। আমাদের সেকুরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম ছাদে কেউ উঠেছিলো কিনা। উনি না বললেন। সব কিছু শুনার পর আমাদের কে যা শুনালেন তা এখনও আমার চিন্তা করলে রাতে ঘুমাতে ভয় লাগে। আমাদের বাসার ঠিক পিছনেই সারি সারি পাহাড়। আমরা পাহাড়কে সিলেটে টিলা বলি। সেই টিলার একটি আমাদের বাসা থেকে পায়ে হেঁটে যেঁতে ৩-৪ মিনিট লাগে। সেখানে একটি মাজার আছে। লোকে বলে পীরের মাজার। আর মাজারের পাশে অনেকগুলো কবর, তাদের অনেকেই নাকি পক্ষাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছেন (বলে রাখা ভাল সিলেটে অনেক আগে থেকেই পাহাড়ে মানুষের কবর দেয়া হয়, আগে এই গোরস্থানগুলোর সঠিক কোন হিসাব ছিলনা)। সেসব ঘটনা কয়েক শতবছর আগের। তাদের অনেকের আত্মা নাকি এখনও এলাকাতে রাতের বেলা দেখা যায়। রাতের বেলা আমাদের এলাকতে জীন দেখা যেন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আমি এতদিন শুধু লোকমুখেই শুনতাম এইবার নিজেও দেখলাম। ঘটনার পরে আমি খারাপ স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। স্বপ্নগুলোর একটা ছিল এরকম; আমাদের বাসার পিছনের পাহাড়ের মাথা খুলে যাচ্ছে আর তার ভিতর অনেকে প্রবেশ করছে আর বের হচ্ছে; মানুষরূপী কিন্তু ভাব্লেশহীন তাদের চেহারা আর আকার অনেক বড়। আমিও তাদের সাথে ভিতরে যাচ্ছি; গিয়ে দেখি ভিতরে অনেক বড় শহর; সেইখানে সবাই কোন না কোন কাজ করছে। সূর্যের আলোর বদলে চারিদিকে আগুনের আলো জ্বলছে, এত বাস্তব সব কিছু আমার চোখের সামনে এখনও ভাসে। স্বপ্ন স্বপ্নই; তবুও এর অর্থ আমি বহুবার খোঁজার চেষ্টা করেছি কোনও উত্তর দাড় করাতে পারিনি। আমি আমার সেই বন্ধুদের সাথে এইসব ব্যাপারে কথা বলতাম না; তারাও ঘটনাটি এড়িয়ে চলতো আমি বুঝতে পারতাম। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু আমার জীবন অনেকটাই পাল্টে যায় এরপর থেকে। এই ঘটনার পর আমি বহুদিন ছাদে উঠিনি। এখনও চিন্তা করলে আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আগে আমি বাসায় একা থাকতাম মাঝেমধ্যে আর আমার পরিবার ঢাকাতে যেত। তখন আমার বয়স ১৩-১৪ হবে। তখনও অনেক আজব ঘটনা ঘটতো। আজব শব্দ পেতাম, দরজা ভিড়ানোর আওয়াজ পেতাম যদিও আমি তখনও কিছু দেখিনি তাই ভয় পেতাম না। কিন্তু ছাদের সেই অশরীরী ঘটনার পর একা বাসায় থাকার কথা আর কল্পনাও করতে পারিনা।