কানে পানি জমা :
কারণ ও প্রতিকার
অধ্যাপক মেজর (অব.)
মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম
বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে কানে পানি জমা রোগের হার খুবই বেশী। এ রোগে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বেশী আক্রান্ত হয়ে থাকে।
যদিও সহজভাবে সাধারণের বুঝার জন্য ‘কানে পানি জমা’ বলা হয়ে থাকে, কিন্তু আসলে এই পানি জাতীয় পদার্থ ঘনত্বের পরিমাণ অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের হতে পারে, যেমন – আঠালো রক্তের মতো, পানির মতো ইত্যাদি। কানের মধ্যে প্রদাহের কারণে পানি জাতীয় পদার্থ জমলে, এর ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন নাম রয়েছে, যেমন – নন সাপুরেটিভ অটাইটিস মিডিয়া, ইয়ার ক্যাটারাল অটাইটিস মিডিয়া, সিক্রেটরি অটাইটিস মিডিয়া ইত্যাদি। অবশ্য বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এর নামকরণ অটাইটিস মিডিয়া উইথ ইফুউশন সংক্ষেপে ‘ওএমই’ হিসেবেই বহুল প্রচলিত।
এ রোগ যে কোনো বয়সেই হতে পারে। তবে ৪-৭ বছর বয়সে সবচেয়ে বেশী দেখা যায় এবং দু’কানে একসঙ্গে হয়। শিশুদের শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে মধ্যকর্ণে সাময়িক সময়ের জন্য এ তরল পদার্থ জমা হতে পারে, যা সাধারণত আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায়। তবে শতকরা ৫ ভাগ ক্ষেত্রে এক বছরের বেশী সময় স্থায়ী হয়। অবশ্য বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এ রোগের প্রকোপ কমে যায়। ৮/৯ বছর বয়সের পর এ রোগের ঝুঁকি বেশ কম থাকে।
কানে পানি জমা রোগ হওয়ার লক্ষণ
কানে পানি জমলে, যেসব স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়, তা নিম্নরূপ –
১. এই রোগের প্রধান বা মৌলিক উপসর্গ হচ্ছে কানে কম শোনা। কানে কম শোনা অনেক সময় স্কুলের শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব, পিতা-মাতা কিংবা অন্যান্য আপনজন দ্বারা চিহ্নিত হতে পারে।
এ রোগের প্রাদুর্ভাব এভাবে হয় যে, মধ্যকর্ণে পানি জাতীয় তরল পদার্থ জমা হতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে তা আঠালো জাতীয় পদার্থে পরিণত হয়ে শব্দ চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়।
এই সমস্ত রোগীরা পড়াশোনা বা অন্য কোনো কাজে অমনোযোগী হয়ে থাকে। আর বিশেষভাবে তারা কথা বা ভাষা শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কারণ, ছেলেমেয়েদের ৫ বছর বয়স পর্যন্ত কানে শোনা ও কথা বলা শেখা সমান গতিতে চলে। সুতরাং যে ছেলে-মেয়ে কানে কম শোনে, তার কথা বলার ক্ষমতা অনেকাংশে লোপ পায়।
২. কানে ব্যথা হয়।
৩. কানে শোঁ শোঁ কিংবা ভোঁ ভোঁ শব্দ করে।
৪. মাথা ঘোরে।
৫. এ রোগ কানের পর্দায় পকেট তৈরী করে এবং তা বাড়তে বাড়তে কোলেস্টিয়াটোমা তৈরীতে সহায়ক হয়। আর তা পরবর্তীতে কান পাকা রোগে পরিণত হয়।
কানে পানি জমা রোগ নির্ণয়
নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে কান পরীক্ষা করে এ রোগ নির্ণয় করা যায় –
এ রোগে আক্রান্তের কান ভালোভাবে দেখলে বোঝা যায়, কানের পর্দা ভেতরের দিকে চেপে আছে। এ সময় কানের পর্দায় আলো ত্রিকোণ অনুপস্থিত থাকতে পারে বা পরিবর্তিত হতে পারে আর ম্যালিয়াস অস্থির থাতলটি ছোট দেখায় এবং ভূমির সঙ্গে সমান্তরালে অবস্থান করে।
অডিওমেট্রি করে শ্রুতিহ্রাসের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। টিমপেনোমেট্রি করে দেখা যায় – কানে নেগেটিভ চাপ সৃষ্টি হয়েছে কি-না এবং মধ্যকর্ণের কমপ্লায়েন্স কমে গেছে কিনা। এ রোগ হলে, উভয় টেস্টের ফলাফল হ্যাঁ-বোধক হয়।
কানে পানি জমা রোগ হওয়ার কারণ
কানে পানি জমা রোগ হওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যা নিম্নরূপ –
১. শিশুদের এডিনয়েড বড় হওয়ায় গলা ও মধ্যকর্ণের সংযোগনালীর (শ্রুতিনালী) কাজে হেরফের হলে।
২. কানের ইস্টাশিয়ান টিউব বন্ধ হলে। এই ইস্টাশিয়ান টিউব বন্ধ হয় নাকের পেছনের টনসিল বা এডিনয়েড বড় হলে অথবা নাকের পেছনের ঠিক আলা জিহবার উপরের অংশে অর্থাৎ ন্যাজোফ্যারিংসে কোনো টিউমার বা টিউমার জাতীয় রোগ হলে।
৩. বিমানে উড্ডয়নের সময় বায়ুমণ্ডল ও বিমানের ভেতরের চাপের তারতম্যের ফলে ইস্টাশিয়ান টিউব বন্ধ হলে। এ কারণে কান বন্ধ হয়ে যায় এবং এটা সাধারণত বিমানে ওঠা-নামার সময় বেশী হয়ে থাকে।
৪. মুখগহ্বরের মধ্যের উপরের তালু জন্মগতভাবে কাটা বা ফাটল থাকলে কিংবা তালুর অকার্যকারিতার কারণে।
৫. ধূমপানজনিত কারণে।
৬. পুনঃ পুনঃ সংকটজনক কানপাকা রোগ হলে কিংবা তার ত্রুটিপূর্ণ বা অপর্যাপ্ত চিকিৎসার কারণে।
৭. ঘন ঘন শ্বাসনালীর উপরের অংশের প্রদাহ হলে।
৮. নাকের মধ্যে গোশত (Tunbinate) বড় হলে কিংবা টিউমার বা টিউমার জাতীয় কোনো রোগ অথবা সাইনোসাইটিস রোগ হলে এবং তাতে ইস্টাশিয়ান টিউব বন্ধ হয়ে কানে পানি জমে।
৮. ভাইরাস জাতীয় জীবাণু দ্বারা মধ্যকর্ণ আক্রান্ত হলে।
৯. এলার্জিজনিত কারণে।
এছাড়াও আরো অনেক কারণ রয়েছে, যেগুলো নিয়ে এখনো চিকিৎসা বিজ্ঞানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
সময়মতো চিকিৎসা করা জরুরী
কানে পানি জমা রোগ দু’রকমের হয়ে থাকে। যথা – (১) সংকটজনক বা একিউট এবং (২) দীর্ঘকাল স্থায়ী বা ক্রণিক রোগ। এই রোগ দীর্ঘকাল স্থায়ী রোগ। তা সাধারণত শিশু-কিশোরদের বেশী হয়ে থাকে। যদি ছেলেমেয়েদের কিংবা শিশু-কিশোরদের রোগের সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ও উপযুক্ত চিকিৎসা করা না হয়, তবে এটা সামাজিকভাবে তাকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন করতে পারে।
কানে পানি জমা রোগের চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য – (১) কানের মধ্যে পানি জাতীয় পদার্থ বের করা, (২) সেই সঙ্গে আর যাতে পানি না জমতে পারে তার সঠিক ব্যবস্থা করা। সুতরাং এর চিকিৎসায় প্রথমে কান পরিষ্কার করে ওষুধ দ্বারা প্রদাহ নিবারণের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু ওষুধে যদি কোনো উপকার না আসে, তবে সংশ্লিষ্ট অপারেশনের দরকার হতে পারে।
(লেখক : নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল – ঢাকা)