আধ্যাত্মিক দর্পণ ::::: এপ্রিল – ১২

গীবত ও চোগলখোরীর

ধ্বংসাত্মক পরিণাম

মাওলানা আবদুল হান্নান তুরুকখালী

যেসব কারণে আমাদের সমাজে অশান্তি ও অরাজকতা বিরাজ করছে, সেসব কারণের মধ্যে অন্যতম হলো গীবত ও চোগলখোরী। গীবত ও চোগলখোরীর কারণে আমাদের সমাজে অশান্তির অগ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলছে। এই গীবত ও চোগলখোরীর কারণে পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই আছে।

 

গীবতের ভয়াবহতা

গীবত ও চোগলখোরী থেকে বিরত থাকার জন্য ইসলামে কঠোরভাবে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনেক ধারণা করা থেকে বিরত থাক। কারণ, ধারণা কোনো ক্ষেত্রে পাপ হয়ে থাকে এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। আর তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো তা ঘৃণাই করবে।” (সূরাহ হুজুরাত, আয়াত : ১২)

এ আয়াতে গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করার সমতুল্য বলা হয়েছে। এতে এর জঘন্যতা ফুটে ওঠে।

গীবত করার ভয়াবহ পরিণাম বর্ণনা করে পবিত্র কুরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, “প্রত্যেক হুমাজাহ (অসাক্ষাতে নিন্দাকারী) ও লুমাজাহ (সাক্ষাতে নিন্দাকারী)-এর জন্য দুর্ভোগ রয়েছে।” (সূরাহ হুমাজাহ, আয়াত : ১)

উক্ত আয়াতে সাক্ষাতে-অসাক্ষাতে নিন্দা করা বা গীবত করাকে ধ্বংসের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

গীবত করাকে জঘন্য পাপ ঘোষণা করে হযরত আবু সাঈদ (রা.) ও হযরত জাবের (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “গীবত ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য পাপ।” সাহাবায়ে কিরাম (রা.) আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! গীবত কিভাবে ব্যভিচার হতে জঘন্য? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, “কোনো ব্যক্তি যখন ব্যভিচার করে অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করে, তখন আল্লাহ তা‘আলা তার তাওবা কবুল করেন। কিন্তু গীবতকারীকে আল্লাহপাক ক্ষমা করেন না – যে পর্যন্ত যার গীবত করা হয়েছে সে ক্ষমা না করে।”

এ কারণেই হযরত আনাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “ব্যভিচারকারীর তাওবা আছে, কিন্তু গীবতকারীর তাওবা নেই।” (বাইহাকী)

গীবত এমন জঘন্য অপরাধ যে, এই অপরাধের কারণে গীবতকারীর নেক আমল নষ্ট হয়ে যায়। হযরত আবু উমামা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “কিয়ামতের দিন মানুষের হাতে আমলনামা তুলে দেয়া হবে। তখন অনেক মানুষ বলবে, হে আমার রব! দুনিয়ার জীবনে  আমি এই এই নেক আমল করেছিলাম, কিন্তু আমার আমলনামায় তা দেখছি না। আল্লাহপাক জবাবে বলবেন, অমুক লোকের গীবত করার কারণে তা তোমার আমলনামা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।” (তারগীব ও তারহীব)

গীবতের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) এক হাদীসে ইরশাদ করেন, “তোমরা গীবত করা থেকে সর্বদা সাবধান থাক! কারণ, এতে তিনটি খারাবী রয়েছে : (১) গীবতকারী ব্যক্তির দু‘আ কবুল হয় না। (২) গীবতকারীর নেক আমল গ্রহণযোগ্য হয় না। (৩) তাকে সীমাহীন পাপের বোঝা বহন করতে হয়।

গীবত ও চোগলখোরী এতই গর্হিত পাপ যে, এরূপ পাপী ব্যক্তি মারা যাবার পর দাফন করার পরপরই তার কবরের আজাব শুরু হয়ে যায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত এক হাদীসে আছে, “একবার রাসূল (সা.) দু’টি নতুন কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি বললেন, এ কবরবাসী উভয়কেই শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ভারী কোনো গুনাহের কারণে নয়, যা থেকে বিরত থাকা তাদের জন্য কঠিন ছিল। অর্থাৎ অতি তুচ্ছ গুনাহ ছিলো, যা থেকে বিরত থাকা তাদের জন্য সহজ ছিলো। আর তা হচ্ছেÑএদের একজন প্রস্রাব থেকে উত্তমভাবে পবিত্রতা অর্জন করতো না এবং অপরজন একজনের কথা আরেকজনের কাছে বলে বেড়াত অর্থাৎ চোগলখোরী করতো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি তাজা খেজুরের ডাল নিয়ে এটাকে দু’ভাগ করে তাদের প্রত্যেকের কবরে একটি করে গেড়ে দিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এমন করলেন কেন? রাসূলুল্লাহ (সা.) জবাবে বললেন, যে পর্যন্ত ডাল দু’টি না শুকায়, সে পর্যন্ত তাদের শাস্তি লঘু করা হবেÑএ আশা করছি। (অর্থাৎ ডালগুলো শুকনো থাকা পর্যন্ত আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করবে এবং এ কারণে তাদের শাস্তি লাঘব করা হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)

উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণ হলো যে, গীবত ও চোগলখোরীর কারণে কবরে কঠিন আজাব হবে। গীবত ও চোগলখোরীর ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “যে চোগলখোরী করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (বুখারী ও মুসলিম)

 

গীবতের প্রকারভেদ

কিভাবে দোষচর্চা করলে গীবত হবেÑতার স্পষ্ট বর্ণনাও হাদীস শরীফে রয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কিরামকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান, গীবত কাকে বলে? সাহাবীগণ (রা.) বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, গীবত হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন আলোচনা করাÑযা সে অপছন্দ করে। সাহাবীগণ (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, আমরা যা আলোচনা করছি, তা যদি ভাইয়ের মধ্যে থেকে থাকে, তাহলেও কি গীবত হবে? রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বললেন, সেটাই তো গীবত। আর যদি সেই দোষ তার মধ্যে না থাকে, তাহলে সেটা হবে মিথ্যা অপবাদ।” (মুসলিম শরীফ)

কোনো ব্যক্তির অসাক্ষাতে তার দেহ, বংশ, কাজকর্ম, এমনকি পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে ব্যঙ্গ বা সমালোচনামূলক আলোচনা করলেও তা দোষচর্চা বা গীবতের মধ্যে গণ্য হবে। যেমন, অমুকের গায়ের রং বিশ্রী, তাকে দেখতে বেঢঙা লাগে, অমুক নি¤œজাতের মানুষÑএরূপ বললেও গীবতের মধ্যে গণ্য হবে।

একবার হযরত আয়িশা (রা.) জনৈকা মহিলার পোশাক সম্পর্কে কিছু বিরূপ মন্তব্য করলেন। তা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আয়িশা (রা.)কে সতর্ক করে বললেন, হে আয়িশা! তুমি তো গীবত করে ফেলেছ। এক্ষুণি থুথু ফেল। হযরত আয়িশা (রা.) থুথু নিক্ষেপ করলে সাথে সাথে তার মুখ থেকে এক টুকরা গোশত বেরিয়ে এলো। (তারগীব ও তারহীব)।

একবার এক মহিলা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে আসল। মহিলাটি ছিলো বেঁটে আকৃতির। মহিলাটি প্রয়োজন শেষ করে চলে যাবার পর হযরত আয়িশা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এই মহিলাটি কতই না বেঁটে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, “হে আয়িশা! এই কথার দ্বারা তুমি সেই মহিলার গীবত করলে!” (মুকাশাফাতুল কুলুব)

গীবত করা যেমন মারাত্মক অপরাধ, গীবত শ্রবণ করাও তেমনি অপরাধ। রাসূলুল্লাহ (সা.) এক হাদীসে ইরশাদ করেন, “গীবতকারী ও গীবত শ্রবণকারী উভয়ে সমান অপরাধী।” (মিশকাত)

জীবিত লোকদের গীবত করা যেমন মহাপাপ, তেমনি মৃত ব্যক্তির গীবত করাও মহাপাপ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা মৃত ব্যক্তির গুণ আলোচনা কর এবং তার দোষচর্চা বা গীবত করা থেকে বিরত থাক।” (আবু দাউদ ও তিরমিযী)

রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো ইরশাদ করেন, “তোমাদের কেউ মারা গেলে, তাকে তার অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও। কখনও তোমরা নিজেদেরকে তার কোনোরূপ দোষচর্চায় লিপ্ত করো না।” (আবু দাউদ)

দৈনন্দিন জীবনে আমরা চলাফেরা ও ওঠা-বসায় অনেক গীবত করে ফেলি, যার জন্য পরকালে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। অনেকে গীবত করাকে একটি সাধারণ অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে ধ্বংসাত্মক কাজ। আমাদের এত্থেকে তাওবা করে নিজেদেরকে সংশোধন করে নিতে হবে।

 

গীবত থেকে বাঁচার উপায়

গীবতের গুনাহ থেকে বাঁচার একটি মাধ্যম হচ্ছে, যেখানে কারো গীবত করা হয়, সেখান থেকে চলে যাওয়া অথবা গীবত করতে বাধা দেয়া, অথবা যার গীবত করা হচ্ছে, তার প্রশংসা শুরু করে দেয়া। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম (র.) একটি জিয়াফতের মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। তিনি শুনলেন, এক ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার গীবত করা হচ্ছে। তিনি তা শুনেই দস্তরখানা থেকে উঠে চলে গেলেন এবং নিজ বাড়ীতে গিয়ে নিজের আত্মাকে এই বলে তিরস্কার করতে লাগলেন, “যদি তোমার মধ্যে খাবারের লোভ না থাকতো, তাহলে তুমি সেখানে উপস্থিত হতে না এবং অন্যের গীবত শুনতে হতো না। হে ইবরাহীম! হাশরের ময়দানে আল্লাহর কাছে তুমি এ ব্যাপারে কী জবাব দেবে?” হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রা.) এই আক্ষেপ করেই তিনদিন পর্যন্ত কোনো খাদ্যদ্রব্য স্পর্শ করেননি। (তাম্বীহুল গাফিলীন)

গীবত থেকে বাঁচার জন্য যাবতীয় অযথা কথাবার্তা ত্যাগ করে নীরবতা পালন করা উচিত। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি নীরব রয়েছে, সে মুক্তি পেয়েছে।” (তিরমিযী, বাইহাকী)

আর শয়তানের ধোঁকায় কারো গীবত করে ফেললে, অবিলম্বে তার নিকট ক্ষমা চেয়ে অপরাধ মাফ করিয়ে নিতে হবে। অন্যথায় এ জন্য পরকালে আটকে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটা হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হকের অন্তর্ভুক্ত, যা বান্দা মাফ না করলে, আল্লাহ তা‘আলা মাফ করবেন না।

Related posts

Leave a Comment