বাংলাদেশে এমএলএমঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা-৩

বাংলাদেশে এমএলএমঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা-৩

(পূর্ব প্রকাশের পর)
এমএলএম সম্পর্কে চরম সত্য অথচ কিছু ভ্রান্ত ধারনা
undefinedপূর্ব কথা
এই ব্যবসা পদ্ধতিটি সম্পর্কে বর্তমানে বাংলাদেশে নেতিবাচক ধারণা পোষণকারী মানুষের সংখ্যা হয়তো বেশি, কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে এই এম.এল.এম বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং ব্যবসাটি বর্তমানে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। কেউ এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন, কেউ অর্থ উপার্জনের আশায় টাকা খুইয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন আর কেউবা নেটওয়ার্কারের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। লেখার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিসহ রুচিশীল মন্তব্য প্রত্যাশা করছি।

পর্ব-১
পর্ব-২
আমি যদি বলি এমএলএম বা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার প্রধান কাজ হচ্ছে ‘পণ্য বিপণন করা’ তাহলে যারা বাংলাদেশে এই ব্যবসার সাথে পরিচিত তাদের অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। কেবল যারা এ জাতীয় ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের একটি অংশ আমাকে সাপোর্ট করতে পারেন। কারণ এটাই প্রকৃত সত্য। কিন্তু এই প্রকৃত সত্য কথাটির আড়ালে আমাদের দেশে যেটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সেটা হল, এমএলএম বা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার প্রধান কাজ হচ্ছে ‘সদস্য সংগ্রহ’। কেউ কেউ আরেকটু আগ বাড়িয়ে বলতে পারেন ‘মানুষ ঢুকানো’। আবার যারা এই ব্যবসার সাথে মোটামুটিভাবে জড়িত তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলতে পারেন ‘ডান হাত ও বাম হাত পূরণ করাই’ হচ্ছে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং এর কাজ।

কেবল এতটুকু ধারনা নিয়েই যদি সকলে বসে থাকতেন, তাহলেও নিদেনপক্ষে সহজে কেউ এ ব্যবসাটির বিরোধীতা করতে পারতেন না। কিন্তু সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বর্তমানে এই এমএলএম ব্যবসাটি এমন নেতিবাচকভাবে মিশে গেছে যে, কেউ কাউকে এ সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেও তাকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। যদিও বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানি তাদের মার্কেটিং ডিস্ট্রিবিউটরদের ট্রেনিং দিয়ে বিভিন্ন কলাকৌশল শিখিয়ে দিয়েছে এবং অনেকেই তা রপ্ত করতে পেরেছেন তবুও এসব এখন আর কোন কাজেই লাগছে না। এমন কি কেউ যদি তার পরিচিত কাউকে ফোন করে বলেন, ‘আপনার সাথে আমার একটা জরুরি বিষয়ে আলাপ আছে’, তবে ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি এমএলএম এর দাওয়াত ভেবে আতংকিত হয়ে যান অনেক ক্ষেত্রে। আর কেউ যদি আরেকটু স্পষ্ট করে বলে দেন, ‘আমি একটি কোম্পানিতে আছি’ কিংবা ‘আমার অফিসে একবার বেড়াতে আসুন’ , তাহলে শ্রবণকারী ব্যক্তিটির আর বুঝতে বিলম্ব হয় না যে, তিনি এই মাত্র একটি এমএলএম কোম্পানির বিজনেস কনসেপ্টের সাথে পরিচিত হতে যাচ্ছেন। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে অধিকাংশ শিক্ষিত সচেতন ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের এবং শিক্ষার্থী ও বেকারদেরও অনেকেরই এসব ক্ষেত্রে ‘ছেড়ে দেয় মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন কিছু কোম্পানি বা আন্তর্জাতিক সংস্থা এ দেশের মানুষকে টাকা দিয়ে টাকা বানানোর এক নতুন খেলায় আগ্রহী করে তুলতে সক্ষম হয়েছে অত্যন্ত সুকৌশলে। এর ফলে দেশের মানুষেরর মধ্যে এমএলএম সম্পর্কে যে ভুল ধারনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আরো জটিল আকার ধারন করছে।

 

বাংলাদেশে এমএলএমঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা-৪

undefined‘প্রসঙ্গঃ নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা’ শিরোনামে বিগত ২০১০ সালের শেষ দিকে এই ব্লগে একটি সিরিজ লেখা শুরু করে মাত্র তিনটি পর্ব লিখেই দীর্ঘ বিরতি দিয়েছিলাম। তৃতীয় পর্ব পড়ার পর অনেকেই সিরিজটি চালিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা ব্যস্ততায় এ বিষয়ে আর লিখতে বসা হয়নি।
তৃতীয় পর্ব…

কেন এই নেতিবাচক ধারনা?
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসার প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারনা একদিনে তৈরি হয়নি। এদেশের মানুষ একসময় এই পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুই জানতো না। আর সেই না জানার সুযোগে একটি বিদেশী কোম্পানি ১৯৯৯ সালে মানুষের হাত থেকে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়েই এ দেশে এমএলএম ব্যবসার আবির্ভাব ঘটে। প্রকৃত ঘটনা কী ঘটেছিল তা ভোক্তভোগীদের মধ্যকার সচেতন কিছু মানুষ ছাড়া বাকীদের ক্ষেত্রে ‘প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেওয়া’ ছাড়া কোম্পানিটির আর কোন কার্যক্রম সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই তেমন কিছু জানতে পারেনি। মানুষ যখন মাথায় হাত দিয়ে ‘হায় হায়’ করতে শুরু করে তখন পত্র-পত্রিকায়ও প্রকাশিত হতে শুরু করে বিভিন্ন সংবাদ। অবশ্য এই ঘটনার আগেও ‘হায় হায় কোম্পানি’ উপাধিটি একাধিক কোম্পানির ভাগ্যে জুটেছিল তবে তা এমএলএম কোম্পানি নয়।

যাই হোক সংশ্লিষ্ট বিদেশী কোম্পানিটি শেষ পর্যন্ত উধাও হয়ে যায়। বাস্তবে তারা ভিন্ন নামে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। কোম্পানিটি ছিল শ্রীলংকান বংশদ্ভূত একজন কানাডিয়ান নাগরিকের মালিকানাধীন। তিনি প্রথমবার বাংলাদেশে ব্যবসা করতে এসে ধাক্কা খেয়ে নতুন পথ বেছে নিতে দেরী করেননি। তবে আরো কিছুদূর এগোতে না এগোতেই তাঁর এদেশীয় বন্ধু মহল আরেকবার তাঁকে ধাক্কা দিয়ে বসেন। তারপর চলে আসে নতুন শতাব্দী।

২০০০ সালের শেষ দিকে (ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ) আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশী মালিকানাধীন এমএলএম কোম্পানি ‘ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড’।
তার পর থেকেই মূলতঃ এমএলএম ব্যবসা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বিদেশী মালিকানাধীন ‘নিউওয়ে’ আর দেশীয় মালিকানাধীন ‘ডেসটিনি’ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছিল অনেকটা সমান তালেই। এরা মানুষকে যেমন এমএলএম এর শিক্ষা দিয়েছে তেমনই নেতিবাচক ধারনারও জন্ম দিয়েছে।

‘নিউয়ে বাংলাদেশ প্রাঃ লিঃ’ দীর্ঘ এক দশক ধরে মানুষের কাছ থেকে কৌশলে নগদ অর্থ সংগ্রহ করেছে, বিনিময়ে দিয়েছে সাইকেল ভিত্তিক কমিশন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘পণ্যের উপস্থিতি’ থেকে গেছে কেবল কাগজে কলমে। তারা যে প্রক্রিয়ায় ব্যবসা করেছে তা ১০০% সঠিক হলেও তাদের অনেক গ্রাহকই সেটাকে বুঝতে পারে নি।

অন্যদিকে ‘ডেসটিনি’ নিউওয়েকে অনুসরণ করতে গিয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। তারা পণ্যই বিক্রি করে তবে সঙ্গে যুক্ত করে বড় অংকের ‘চার্জ বা জয়েনিং ফি’।
তাদের এ প্রক্রিয়াটি এক সময় ফ্লপ মারে। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে ‘বনায়ন’ কর্মসূচি নিয়ে আসে। সাময়িকভাবে কিছুটা ইতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গি তৈরি করতে সক্ষম হলেও তাদের এই কাজটি মূলতঃ নগদ অর্থ সংগ্রহ করারই নামান্তর।

বাংলাদেশে এ দু’টি কোম্পানির গ্রাহকই সবচেয়ে বেশি বলে জানা যায়। দু’টি কোম্পানির তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উভয় কোম্পানি মানুষের কাছে এমএলএম এর বার্তা পৌঁছাতে পারলেও অধিকাংশ নেতিবাচক ধারনার জন্ম তাদের মাধ্যমেই হয়েছে। এর কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। নিম্নে তা উল্লেখিত হলো-
১. নিউওয়ে এবং ডেসটিনি দু’টি কোম্পানিই বাইনারি ও মেট্রিক্স পদ্ধতির ‘বিজনেস প্লান’ ভিত্তিক হওয়ায় মানুষের মধ্যে ‘ডান হাত-বাম হাত’ পূরণের আতংক তৈরি হয়!

২. কোম্পানিগুলোর কোন নিজস্ব পণ্য না থাকায় তাদের সরবরাহকৃত বিভিন্ন পণ্য মূল্য বাজার মূল্যের অধিক হওয়ায় সাধারণ মানুষ এসব পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকে।

৩. উল্লেখিত ২টি কোম্পানিসহ অন্যান্য কোম্পানিরও পণ্য তালিকায় মানুষের প্রয়োজনীয়/ নিত্য ব্যবহার্য পণ্য বরাবরই অনুপস্থিত থাকে।

৪. নিজের পেশাকে ঠিক রেখে পার্ট-টাইম কাজ করার অফার দিলেও কোম্পানিগুলো মানুষকে অস্বাভাবিক আয়ের অবাস্তব স্বপ্ন দেখাতে থাকে।

৫. ‘এমএলএম কোম্পানিতে জয়েন করার বা সদস্য হওয়ার একমাত্র পথই হলো সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে একটি পণ্য ক্রয় করা নিজের ব্যবহারের জন্য’ এই ধারনা বদলে গিয়ে ‘কোম্পানির সদস্য হতে হলে কিছু টাকা দিতে হয়’ এই ধারনাটি মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়।

৬. ‘প্রত্যেক সদস্যের কাজ কোম্পানির পণ্য বিপণন কার্যক্রমে অংশ নেয়া’ ধারনাটি বদলে গিয়ে মানুষের মধ্যে এই ধারনার জন্ম হয় যে, ‘কোম্পানির সদস্যদের কাজই হচ্ছে নতুন সদস্য তৈরি করা’।

৭. অধিকাংশ সদস্যই বিজনেস প্লান ভাল করে না বুঝে (অনেকে বুঝার পরও) নিজের আয় বাড়ানোর জন্য নতুন মানুষকে চাপাচাপি করে কিংবা বিভিন্ন লোভনীয় বিভ্রান্তিমূলক অফার দেওয়ায় মানুষ জয়েন করার পরে এসব কথার মিল না পেয়ে পুরো এমএলএম ব্যবস্থাকেই প্রতারণামূলক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতারক মনে করে।

এরকম আরো অনেক কারণেই মানুষের মধ্যে এমএলএম এর ব্যাপারে ‘নেতিবাচক ধারনা’ তৈরি হয়।সাম্প্রতিক সময়ে ‘ইউনিপেটুইউ’ এবং এ জাতীয় আরো কিছু কোম্পানি মানুষকে এই ব্যবসার বিষয়ে নেতিবাচক ধারনা তৈরির চূড়ান্ত প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে।

Related posts

Leave a Comment