মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের ইতিহাস,…

মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের ইতিহাস

 

১৯৪১ সালে সর্বপ্রথম ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ভিটামিন কোম্পানি তাদের অপ্রচলিত ভিটামিন বাজারজাতকরণের জন্য মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) পদ্ধতির মার্কেটিং শুরু করে। সমসাময়িক অন্যান্য বিখ্যাত কোম্পানি যেমনÑ ফোর্ড, ক্যাটারপিলার প্রভৃতি, তারা এ ধরনের মার্কেটিং পদ্ধতির মাঝে কোনো উৎসাহ খুঁজে পায়নি। কেননা ক্রেতা তার প্রয়োজনেই যাচাই-বাছাই করে দ্রব্যটি কিনবে এ ব্যাপারে বড় বড় কোম্পানি আত্মবিশ্বাসী ছিল। কিন্তু মানহীন অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর এই আত্মবিশ্বাস ছিল না।

 

বিশ্বে এ পর্যন্ত যত এমএলএম কোম্পানি দেখা যায় তাদের বেশিরভাগেরই  দ্রব্য হলো অপ্রচলিত দ্রব্য যেমনÑ খাদ্য পরিপূরক, বলবর্ধক, ওজনহ্রাসক, সৌন্দর্যবর্ধক প্রভৃতি। মূলত এ ধরনের অপ্রচলিত দ্রব্যের বাজারজাতের ক্ষেত্রে এই এমএলএম পদ্ধতির মার্কেটিং বেছে নেয়া হয়। অথবা বলা যায় এমএলএম ব্যবাসীয়রা এ ধরনের অপ্রচলিত তাদের ব্যবসার বিষয় হিসেবে বেছে নেয়। অপ্রচলিত দ্রব্য যেহেতু মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নয়, তাই এ জাতীয় দ্রব্যের অনেক গুণাগুণ বর্ণনা করে বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিশ্বাসকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে হয়।

 

অন্যদিকে অপ্রচলিত দ্রব্যের গুণাগুণ ও মূল্য যাচাই করার সুযোগ খুব একটা থাকে না। ফলে কোম্পানি তার বিক্রীত দ্রব্য ইচ্ছামতো মূল্যে বিক্রয় করে, যাতে বিক্রয় প্রতিনিধিকে খুশি করার মতো পরিমাণে লাভ ওই বিক্রীত দ্রব্য বিক্রয় করা থেকে কোম্পানিটি তুলে নিতে পারে।

 

বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত রাষ্ট্রে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা প্রথম যখন তার যাত্রা শুরু করে সে সময় এই ব্যবসা পদ্ধতিটি অপ্রচলিত হওয়ায় দেশের সরকার বা জনগণ এই ব্যবসার সম্পর্কে ভালো-মন্দ কিছু জানত না বা বুঝতে পারত না। পরবর্তী সময়ে জনগণ বারবার প্রতারিত হতে থাকলে রাষ্ট্র আইন করে মাল্টি লেভেল মার্কেটিংকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে ডাইরেক্ট সেলিং পদ্ধতি জনসাধারণের স¦ার্থবিরোধী না হওয়ায় রাষ্ট্রগুলো এ পদ্ধতির মার্কেটিংকে অনুমোদন দিয়েছে। যদিও ধূর্ত এমএলএম ব্যবসায়ীরা ডাইরেক্ট সেলিং পদ্ধতির মার্কেটিং  এবং মাল্টি লেভেল মার্কেটিংকে একই জিনিস বলার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে পদ্ধতি দুটির মাঝে সূ² পার্থক্য রয়েছে। ডাইরেক্ট সেলিং মার্কেটিংকে ওয়ান টু ওয়ান পদ্ধতির মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বলা হয়, যা মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের অন্যান্য পদ্ধতি যেমন পিরামিড পদ্ধতি, ডাউনলাইন পদ্ধতি, চেইন পদ্ধতির চেয়ে একেবারেই ভিন্নতর। মূলত মার্কেটিং পদ্ধতিগুলো এতই অপ্রচলিত যে, মার্কেটিংয়ের ওপর পড়াশোনা করা ব্যক্তি বা গবেষকদেরও অনেক সময় বিষয় দুটির পরিষ্কার পার্থক্য বুঝতে কষ্ট হয়। আর জনসাধারণ ও রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের জ্ঞানের ঘাটতির সুযোগ নেয় ধূর্ত এমএলএম ব্যবসায়ীরা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা-দুর্ঘটনার পর রাষ্ট্র ও জনগণ বুঝতে শিখে  এবং অতঃপর আইন করে এমএলএম ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, পুর্তগাল, অস্ট্রিয়া, জাপান, চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, নেপালসহ ৫২টি দেশে পিরামিড পদ্ধতির মাল্টি লেভেল মার্কেটিং সরকারিভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে।  এমএলএম ব্যবসার বিভিন্ন প্রতারণার ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, সুইডেন প্রভৃতি দেশে এমএলএম কোম্পানির বিরুদ্ধে দেশগুলোর সরকার মামলা করেছে, কোম্পানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, জরিমানা আদায় করেছে। এমনকি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) তাদের ওয়েব পেইজে জনসাধারণকে এমএলএম কোম্পানির প্রতারণা থেকে নিরাপদ থাকার নির্দেশনামূলক হুশিয়ারি দিয়ে একটি পেইজ বরাদ্দ রেখেছে। চীনে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের প্রতারণার পর এমএলএম ব্যবসা বন্ধের দাবিতে ১৯৯৮ সালে জনরোষ থেকে চীনে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে চীন সরকার এমএলএম ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ আইন তৈরির কাজ শুরু করে ও ২০০৫ সালে ডাইরেক্ট সেলিং আইন তৈরি করে। টেলিফোন বা ইন্টারনেটে অর্ডার দিয়ে হোম ডেলিভারি গ্রহণ, ডোর টু ডোর মার্কেটিং, টেলি মার্কেটিং, ডিট্টো মার্কেটিং প্রভৃতি পদ্ধতির মাল্টি লেভেল মার্কেটিংকে বৈধতা দেয়। আর অবৈধ ঘোষণা করে ডাউন সেলিং, চেইন সেলিং, পিরামিড পদ্ধতি প্রভৃতি মাল্টি লেভেল মার্কেটিংকে। বৈধ ঘোষণা করা ডাইরেক্ট সেলিং পদ্ধতির মার্কেটিংয়ে শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারী ও সরকারি কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে না মর্মে আইন জারি করে।

Related posts

Leave a Comment