কিছুদিন আগে আমার ছোট খালু বাসায় বেড়াতে এসেছে , খালুজানের আগমনের কথা শুনেই আমি আমার রুমে টুপ করে ডুকে দরজা লক করে দিলাম । ভাবখানা এমন – পড়াশুনায় ব্যাপক ব্যস্ত , এখন কারও সাথে দেখা করতে পারবো না ।“ খালুজানকে আমি একটু এড়িয়ে চলি । এড়িয়ে চলার কারন আমাকে দেখলেই তিনি একটি প্রশ্নই করবেন আর কিছু না আর সেটা হল – cgpa এর কি অবস্থা ?
বেশীক্ষণ লুকিয়ে থাকা গেল না , রাতে খাবার টেবিলে খালুজানের মুখোমুখি , তিনি ভাত মাখাতে মাখতে আম্মু কে বলছে – আপা , আমার বড় বোনের ছেলের তো পাসপোর্ট হয়ে গেছে , সরকারী খরচেই অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে , তার কিন্তু cgpa ছিল *.**
( পাঠকদের না শুনাই ভাল , আমি নিজেই শুনি না , cgpa এর কথা আসলেই আমি মুখ ও বধির হয়ে যাই )
খালুজানের কথা শুনে আমার মা জননী কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল — মাছ কি আরেক পিস দিব ? “ সর্বদা cgpaগ্রস্ত সেই খালুজান হটাত আমাকে প্রশ্ন করলো – এইবার এশিয়া কাপের খেলা দেখতে মাঠে যাওনি ?আমি বললাম “না” , টিকেট মানেজ করতে পারিনি । আমার কথা শুনে খালুজান অবাক ।
–“ ঢাকায় থাকো , অথচ বাংলাদেশের খেলা দেখতে যাওনি !! বোলো কি ! যেদিন বাংলাদেশের খেলা থাকে সেদিন তোমার ৪ বছরের ছোট্ট খালাতো বোন তো সারাদিন বাংলাদেশের পতাকা মাথায় লাগিয়ে বসে থাকে , আর চীৎকার করে “ সাকিব সাকিব ” করে । ইনশাল্লাহ আগামীবার তাকে মাঠে নিয়ে আসবো । “
বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে এইটা একটা ছোট্ট ঘটনা , এরচেয়েও মাথানষ্ট ক্রিকেট ক্রেজনেস বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটা পরিবার বিদ্যমান । সবধরনের সবপেশার মানুষের কাছে আজ ক্রিকেট ক্রিকেট ক্রিকেট ।
আমাদের আছে হরেক সমস্যা । আছে নোংরা রাজনীতি , আছে দুর্বিষহ লোডশেডিং , খাদ্য ঘাটতি , ভয়ঙ্কর ট্রাফিক , ৪০ বছরেরও বেশী সময় ধরে মানবতা বিরোধী যুদ্ধ অপরাধীদের পাপ আমাদেরকেই বয়ে বেড়াতে হয় ; তারপরও এমন হাজার সমস্যার ভিতর জাতি হিসেবে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই একমাত্র এই ক্রিকেটের হাত ধরেই ।
বাইশ গজের পিচে আমাদের দামাল ছেলেদের খেলা দেখে শক্তহাতে লাল সবুজের পতাকা খামচে ধরে সাতান্ন হাজার বর্গমাইল মাটির প্রতিটা বিন্দু ।
১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ যে ক্রিকেটের সুচনা হয়েছিল কালের পরিক্রমায় আকরাম খান , আমিনুল ইসলাম বুলবুল , খালেদ মাহমুদ সুজন , খালেদ মাসুদ পাইলট , হাবিবুল বাশার সুমন , মাঞ্জারুল ইসলাম রানা এমন অনেক ক্রিকেটারের হাত ধরে আমরা পেয়েছি আজকের এই জাতীয় ক্রিকেট টীম ।
ছোটখাটো হাসিমাখা মুসফিক , মারকুটে তামিম , নড়াইল এক্সপ্রেস মাশরাফি এবং তার সাথে ক্রিকেট দুনিয়ার নতুন সূর্য বাংলাদেশের প্রান “ সাকিব আল হাসান “ শুধু মাত্র ক্রিকেটার না ,তারা আমাদের স্বপ্ন আমাদের ভরশা ।
মুসফিকের উইকেটের পিছনে সতর্কতা আমাদের নিশ্চিন্ত করে , তামিমের এগ্রেসিভ মারদাঙ্গা ব্যাটিং আমাদের উত্তেজিত করে , মাশরাফির গতি আমাদের এগিয়ে চলার প্রেরণা যুগায় । আর সাকিব ! সাকিবের মুখ দর্শনই এক একজন বাঙ্গালীকে করে তোলে মুসা ইব্রাহিম । মুসা ইব্রাহিমের এভারেস্ট জয়ের পর যে অনুভূতি হয়েছিল আমার মনে হয় তেমনি অনুভূতি হয় সকল বাঙ্গালীর যখন সাকিব উইকেট পায় । সাকিবের ব্যাট হাতে একটা রানও আমাদের কাছে ১০০ সেঞ্চুরির চেয়েও অনেক বেশী কিছু ।
সেই প্রানের খেলোয়াড়দের যখন পাকিস্তানে খেলার নামে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার পায়তারা চলে তখন কেমনে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব !
যে দেশের ক্ষমতাবান নেতানেত্রীরা নিজেরাই নিজ দেশে নিরাপদ নয় ( শক্তিশালী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেত্রী বেঞ্জির ভুট্রোকে দিনেদুপুরে হত্যা করা হয় ) সেখানে হত্যা , গুম প্রতিদিনের পানি পানের ঘটনা সেখানে কিভাবে আমাদের ছেলেদের পাঠানো হচ্ছে ? ২০১১ সালেই সন্ত্রাসী হামলায় কমপক্ষে ৬১৪২ জন মারা যায় বলে ধারণা করা হয় ( মৃতের সংখ্যা হয়ত আরও বেশী ) এমনকি গতকালও পাকিস্তানের উত্তর – পচিমাঞ্চলের এক কারাগারে তালেবান জঙ্গিরা হামলা ৪০০ বন্দীকে মুক্ত করেছে ! গত তিন বছর যাবত কোন দেশই যখন পাকিস্তানে যেতে রাজি না তখন বাঙ্গালীকেই কেন “বলির পাঠা” বানানো হচ্ছে !
বলছি না পাকিস্তানে গেলেই আমাদের খেলোয়াড়দের বিপদ হবে , তবে যদি বিপদ হয় ! যদি ২০০৯ সালের শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড়দের মতো আমাদের সোনার ছেলেদের উপর সন্ত্রাসী হামলা হয় , তখন ?( সেই হামলায় কমপক্ষে ৮ জন নিহত হয় । অল্পের জন্য রক্ষা পায় শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারা) লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের এই “পাকিস্তানের মন রক্ষার খেলা ” খেলতে গিয়ে যদি একটা অঘটন ঘটে তারপর কি হবে ?
এই কথা মনে রাখা ভাল, ক্লোনিং করে ভেড়া জন্ম দেয়া যায় কিন্তু সূর্যসম সাকিব আল হাসান কে জন্ম দেয়া যাবে না । বহু পরাজয়ের পর বাঙ্গালী সাকিবদের পেয়েছে , লোটাস কামালের মতো লোভী পাচাটা কুকুরের কোন অধিকার নেই সেই বাংলাদেশের সম্পতি নিয়ে লীলাখেলা করার ।
খেলতে যদি হয় নিরপেক্ষ ভেনুতে খেলা যায় । আবুধাবি , দুবাই তো পাকিস্তানের দুলাভাই । দরকার হলে সেখানে খেলা হবে । অনেকেই বলছে এইবার পাকিস্তান না গেলে তারা নাকি বিপিঁএল এ অংশগ্রহণ করবে না । না করুক , আইপিঁএল কি পাকিস্তানি প্লেয়ার ছাড়া জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে ?মোটেও হারায় নি তবে বিপিএল কেন হারাবে ?
ক্রিকেট বোর্ড এর নষ্টামির জন্য হয়তো আমাদের ছেলেরা বাধ্য হবে পাকিস্তান যেতে , কিন্তু আমাদের সরকার কি ভেবে দেখেছে ক্রিকেটারদের গায়ে একটি আঁচড় তাদের ভোট ভাগ্যে কি নির্মম অভিশাপ নিয়ে আসবে !
জানি না এই সব কথায় কোন লাভ হবে কিনা । শুনতে পাচ্ছি ২৭ এপ্রিল জাতীয় ক্রিকেট দল পাকিস্তানে যাবে বাংলাদেশে ফিরে আসবে ১ মে । আমাদের ভয় একটিই , যদি না ফিরে আসে টাইগাররা ! যদিও বা ফিরে আসে তবে তা লাশ হয়ে তাহলে !!!! এশিয়া কাপ ফাইনাল শেষে মাঠে মুসফিক সাকিবের কান্নাই আমরা সহ্য করতে পারিনি ,তাদের সাথে হু হু করে সমগ্র বাংলা কেঁদে উঠেছে , কিছুদিনপর সকালের ঘুম থেকে উঠে যদি শুনতে পাই “ পাকিস্তানের মাটিতে সাকিব আল হাসানের লাশ “ মানতে পারবো ? আপনি আপবেন ? সত্যি কি সহ্য করা যাবে সেই কথা ???????????