ভালবাসার গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন

ভালবাশার গল্প

[১]

ব্যস্ত শহরের প্রধান সড়কের মোড়েই সাদা রঙের একতলা বাড়িটা ।

পড়ন্ত বিকেলের রোদে বাড়িটা কেমন অদ্ভূত দেখাচ্ছে ।

সাদা রঙের বাড়িটার বারান্দায় উদাসী মনে দাঁড়িয়ে আছে “ইনশা” নামের মেয়েটা।

ইনশার মনটা আজ ভীষন খারাপ।কেনো?তা সে নিজেও জানে না ।ইট-পাথরে তৈরী বাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে কী ভাবছে ও।

চুলোয় চায়ের পানি চড়িয়েছে অনেকহ্মন ।কিন্তু ভাবনায় এতটাই ডুবে গেল ইনশা,যে চায়ের কথা ও ভুলে গেছে ।

কী এত ভাবছে ও?সাদা বাড়িটার প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকল একটা কালো টয়োটা ।

গাড়ির হর্ণে ইনশার ভাবনায় ছেদ পড়ল,সেদিকে তাকাল ।গাড়ির পেছনের সীট ঠেলে বাহিরে বের হয়ে এল আনিস,ইনশার স্বামী ।

স্বামীকে দেখে বারান্দা থেকে হলরূমের দিকে এগোল সে।

আনিসের হাত থেকে ব্রিফকেসটা নিতে নিতে বলল-‘আজ এত তাড়াতাড়ি এলেন যে?’

ইনশার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলো আনিস,’তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল,তাই চলে এলাম।’

আনিসের কথায় ইনশাও একটু হাসল।

রাতে খাবার টেবিলে ইনশাকে ওরকম চুপ দেখে আনিস জানতে চাইল,’কী ব্যপার তোমাকে অমন বিষন্ন দেখাচ্ছে কেনো?

”নাহ,এমনিতে’ বলল ইনশা ।

‘তুমি কী কোন কারনে চিন্তিত?’ আবার জানতে চাইল আনিস ।

এবার ও একই জবাব ইনশার ।এরপর খাবার টেবিলে বিরাজ করল নীরবতা ।

মধ্যরাতে হঠাত্‍ বেজে উঠল ইনশার মোবাইল ফোন ।

ইনশার তন্দ্রা ভেঙে গেল ফোনের আওয়াজে ।

পাশ ফিরে একবার দেখল আনিসকে,গভীর ঘুমে বিভোর সে ।

‘এতরাতে কে ফোন করতে পারে?’ ভাবতে ভাবতে কলটা রিসিভ করল ইনশা ।”হ্যালো…….

[২]

ও পাশের কণ্ঠটা নীরব ।

ইনশা আবার বলল-“হ্যালো,কে বলছেন ?”ওপাশ থেকে এবার ও কোনো সাড়া এল না ।

ইনশা আরও বেশ কয়েকবার হ্যালো বলেও যখন সাড়া পেল না,তখন বিরক্ত হয়ে লাইন কেটে দিল ।

পরদিন ইনশার ঘুম ভাঙলো একটু দেরী করে ।রাতে কখন ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না ।পাশ ফিরে আনিসকে দেখল,এখনও ঘুমুচ্ছে ।

ঘড়ি দেখল ইনশা,সাতটা বেজে দশ মিনিট ।

বাড়ির তেমন কোনো কাজ করা লাগে না তার ।দুজন কাজের মেয়ে আছে,(রিতা ও শেফালী)।খুবই ভাল কাজ করে ।

ইনশা এবং আনিস দুজনেই খুব আদর করে ওদের ।মেয়ে দুটোও অনেক সম্মান করে তাদের দুজনকে ।

শুধু রান্নাটাই করে সে ।আনিস তার হাতের রান্না ছাড়া অন্য কারোটা খায় না ।

খানিকবাদে আনিস এল খাবার টেবিলে ।আনিসের দিকে নাস্তার প্লেট এগিয়ে দিয়ে নিজেও খেতে বসল ইনশা ।

খেতে খেতে কথা চলছে দুজনের-সাংসারিক আলোচনা ।

প্রতিদিনের মত আজ বিকেলে ও ছাদে উঠল ইনশা ।দিনের এই সময়টা ছাদে থাকেতেই পছন্দ করে সে ।

ছাদের এককোণে রয়েছে তার “স্বপ্ন গোলাপ” এর বাগান ।গোলাপ ইনশার প্রিয় ফুল ।

নানা রঙের,নানা জাতের গোলাপ রয়েছে বাগানে ।

মা যেমন করে তার ছোট্ট শিশুটির যত্ন নেন,ইনশাও ঠিক একই ভাবে তার গাছ গুলো দেখাশোনা করে ।

রাতে টিভিতে একটা হরর ছবি দেখছিল সে।অনেক ভয়ঙ্কর,দেখতে দেখতে তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল ।

ছবি দেখায় এতটাই ডুবে গেছে সে যে ফোন কলের শব্দ ও তার কানে পৌঁছোয় নি ।

কাজের মেয়ে রিতা মোবাইল টা নিয়ে দিল তার হাতে-“আফা,আফনের মোবাইল বাজে ।”

কাজের মেয়ের ডাকে হঠাত্‍ একটু চমকে উঠল ইনশা ।পরহ্মনেই সামলে নিল নিজেকে ।

রিতা আবার ও বলল-“আফা ক্যাডায় জানি ফোন করছে ।”

মোবাইলটা রিতার হাত থেকে নিয়ে রিসিভ করল -“হ্যালো ,কে বলছেন?”

ওপাশটা নীরব,কিন্তু কেমন এক অদ্ভুত সুরের আওয়াজ ।মনে হচ্ছে কেউ তানপুরা বাজাচ্ছে ।

ইনশা বুঝতে পারছে না ,শব্দটা টিভিতে হচ্ছে নাকি মোবাইলে ? সন্দেহ দূর করার জন্যে সে টিভিটা অফ করে দিল ।

তারপর মনোযোগ দিয়ে শুনল, কী আশ্চর্য !শব্দটা মোবাইলেই হচ্ছে,স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে ।

আচমকা এক আজব ভয় এসে ভর করল তার মনে ।

তারপর ও সে সাহস করে কয়েকবার হ্যালো বলল ।

কিন্তু সেই একই ফল-নীরবতা । সুরের আওয়াজটা ও কেমন অদ্ভুত !হ্মীণ হতে হ্মীণ আবার উচ্চ হতে উচ্চতর ।

মাতাল সুর,যেন বশীকরণ মন্ত্র ।

কিছুহ্মন শোনার পর কেমন যেন হয়ে গেল ইনশা ।

তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে আর তার মাঝে নেই,মাতাল সুর তাকে বশ করে নিয়ে গেছে অন্য এক জগতে ।

কোন সে জগত-জানে না কেউ !!

[৩]

…”ইনশা,এই ইনশা ।”

অনেকক্ষন ধরে ডেকেও ইনশার কোন সাড়া পেল না আনিস ।হালকা করে ধাক্কা দিয়ে ডাকল -“ইনশা….ইনশা…

আনিসের ধাক্কায় হকচকিয়ে উঠল সে ।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আনিসের দিকে ।বিমূঢ় ভাবটা কাটেনি এখন ও ।

অস্বস্তি লাগছে আনিসের ।ইনশার এই রূপ তার কাছে একেবারেই অপরিচিত ।

আরও একবার ডাকল সে-“ইনশা,কী হয়েছে তোমার?অমন করছো কেন তুমি?”

জীবন্ত মূর্তি হয়ে গেছে সে,আনিসের কোন কথায় তার প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না ।অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে শুধু ।

এই মুর্হূতে কী করা উচিত বুঝতে পারছেনা আনিস ।অস্বত্বিটা বেড়েই চলেছে ।

হঠাত্‍ই ব্যাপারটা খেয়াল করল ,ইনশা কানে মোবাইল ধরে আছে । আলতো করে সরিয়ে নিল মোবাইলটা,তাকাল ইনশার দিকে -কোন পরিবর্তন নেই।

এবার আবার ডাকল সে-“ইনশা (একটু আদুরে কন্ঠে )ইনশা…লহ্মী ইনশা ।এদিকে দেখো,আমি আনিস ।তুমি কী আমায় চিনতে পারছো না?”

এবার মনে হচ্ছে একটু নড়ে উঠল সে ।আনিস তার একটা হাত রাখলো ইনশার কাঁধে ।ঘন ঘন কয়েকবার চোখের পলক ফেলল ইনশা, তাকালো আনিসের দিকে ।

করুণ সেই চোখের চাহনি ।কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি নাড়া দিল আনিসকে ।

-” কী ব্যাপার তুমি! কখন এলে?” বিমূঢ় ভাবটা কেটে গেছে তার ।ইনশার এই রূপটা আনিসের কাছে খুব পরিচিত ।

-“এই তো অনেকক্ষন ।তোমার কী হয়েছিল ইনশা ।এতবার ডাকলাম জবাব দিলে না যে ?”

-“তুমি আমায় ডেকেছিলে নাকি ! কী আশ্চর্য ! কখন?”

-“এই তো…কেনো তোমার কিছু মনে নেই ?”

-” কী মনে থাকবে ?কী বলছ এসব !!” – বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে ইনশার ।

এমন পরিস্থিতিতে হাসি আসার কথা না ।তবুও আনিসের হাসি পাচ্ছে,ইনশার চেহারার ভাব-ভঙ্গি দেখে ।

-” এই তুমি হাসছো কেনো ?”

-” এমনিতে ।”

– “এমনিতে কেউ হাসে না ?” -“ইয়ে ,না মানে, তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে ইনশা ।”

-” বাজে কথা রাখো ।হাসছিলে কেন?”

-” বললাম তো,তোমাকে অনেক…”

– “দেখো,আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি ।”কন্ঠটা গম্ভীর করে বলল ইনশা ।

– “আহা,রেগে যাচ্ছ কেনো ?”কোন মতে হাসিটা চেপে কখাটা বলল আনিস । চুপ করে আছে ইনশা ।

-” তোমার কী আসলেই কিছুই মনে নেই,ইনশা ?”

-” কী মনে থাকবে?কী করেছি আমি?”কথাটা বলতে বলতে ইনাশা চেহারাটাকে এমন করে ফেলল,যেন সে অনেক বড় কোন অপরাধ করে ফেলেছে ।

ইনশার এই রূপটা খুব ভাল লাগে আনিসের ।

ছোট বাচ্চারা কোন অপরাধ করলে যেমন মাথা নিচু করে অনুশোচনা করে,

ঠিক তেমনি ইনশাও নিজের অজান্তে কোন ভুল করলে মাথা নিচু করে কথা বলবে ।

তাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসল সে ।বুঝতে পারল ইনশার কিছুই মনে নেই ।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হঠাত্‍ শব্দ করে হেসে উঠল সে ।আনিসের হাসির শব্দ শুনে মুখ তুলে চাইল ইনশা ।

-” তুমি অমন পাগলের মত হাসছো কেন?”

-”আমি পাগল তো,তাই ।” মধ্যরাতে হঠাত্‍ শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল ইনশার ।কিসের শব্দে ঘুমটা ভাঙল বোঝার চেষ্টা করল সে ।

চোখ বন্ধ করে,কান সজাগ রাখল ।

 

শব্দটা শুনতে পাচ্ছে সে,তবে জোরাল না ।ভাল করে শুনল,কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে ।

চোখ মেলে উঠে বসল বিছানায়, আবার বোঝার চেষ্টা করল ।

হঠাত্‍ই ,পরিবর্তন দেখা গেল ইনশার মাঝে ।”সেই তানপুরার সুর,মাতাল সুর ,বশীকরন মন্ত্র ।”

বিছানা থেকে নেমে দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল ইনশা ।গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলল করিডর ধরে ।

চলতে চলতে বাড়ির মেইন দরজা খুলে বাগানের দিকে যাচ্ছে সে ।যাচ্ছে তো যাচ্ছে একবারের জন্যেও তাকাল না পেছন ফিরে……

[৪]

ভোরের একচিলতে মিষ্টি রোদ এসে পড়ল ঘুমন্ত ইনশার মুখে ।

রোদের আলোয় কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে ।যেন কাল বৈশাখীর কোন কাল রূপ তাকে পুরো গ্রাস করে ফেলেছে ।

ইনশার মাথার কাছে বসে আছে আনিস ।ঘুমন্ত এই মেয়েটিকে কেমন অপরিচিত লাগছে তার।

ভাবতেই অবাক লাগছে তার প্রেয়সী ,তার অর্ধাঙ্গী ,চলার পথের সাথী ,চিরচেনা সেই মেয়েটি আজ কত অচেনা।

সেই চিরচেনার মাঝে এই ইনশা তার একেবারেই অপরিচিতা ।

সকাল গড়িয়ে দুপুর ।সবে ঘুম ভাঙল ইনশার ।পিট পিট করে কয়েকবার চোখের পাতা খুলে আবার বন্ধ করল ।

আনিস এখন ও বসে আছে তার শিয়রে , চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ ।

-“কি ব্যাপার ,তুমি অফিসে যাওনি ?”আধো ঘুম জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করল ইনশা ।

-“না ।”নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব আনিসের ।

-“কেনো ?কি হয়েছে ?যাওনি কেনো ?”

-“তোমার কি হয়েছে ইনশা ?”পাল্টা প্রশ্ন করল সে ।

– “আমার !আমার আবার কি হল ।ভালোই তো আছি ।”

– “তাহলে এমন সব অদ্ভুত কান্ড কেনো করছো ?”

-” অদ্ভুত আচরন !! তোমার কথার মাথা-মুন্ডু ছাই কিছুই বুঝতে পারছি না ।” খুব অবাক মনে হচ্ছে তাকে ।

আনিস তখন ওনির্বাক তাকিয়ে আছে তার দিকে ।

– “চুপ করে আছো কেনো ?কেমন আচরন করি বললে না ।” আবার জানতে চাইল ইনশা ।

-“জানিনা ।” বিরক্ত ভরা কন্ঠে জবাব দিয়ে রূম থেকে বেরিয়ে এল আনিস ।

এই ভর দুপুরে ছাদে উঠে এল সে ।কিছুই ভাল লাগছে না ।সব অসহ্য লাগছে ।সবই বৃথা মনে হচ্ছে ।

কার জন্যে এতকিছু ,এই ভালবাসা ,ভাললাগা ।বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা ।

 

মাঝে পেরিয়ে গেলো পুরো একটি সপ্তাহ ।যতই দিন যায় ততই আনিস-ইনশার সম্পর্কটা জটিল থেকে জটিল আকার নিচ্ছে ।

প্রতি রাত জেগে থাকে আনিস ,পাছে ঘুমোলে ইনশা যদি হারিয়ে যায় ।সারাক্ষন তাকে একটা মানসিক দুশ্চিন্তায় পার করতে হচ্ছে ।

প্রতিটা দিন ,প্রতিটা মুহূর্ত ,প্রতিটা সময় ।এভাবে আর কতদিন চলবে জানে না সে ।

ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।হারিয়ে গেল অদেখা এক স্বপ্ন পুরীতে ……..

[৫]

যতই দিন যায় ,আনিস-ইনশার সম্পর্ক ততই জটিল হতে থাকে ।

সেই সাথে বেড়ে চলে ইনশার পাগলামী ।সহ্য করতে করতে অসহ্য হয়ে পড়েছে আনিস ।

“আর কত ?এভাবে তো জীবন সংসার চলতে পারে না ।আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে ।” যেন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বসল সে ।

পড়ন্ত বিকেল ।ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে ইনশা ।এই মুহূর্তে তাকে অনেক স্বাভাবিক দেখাচ্ছে ।

কে বলবে এই মেয়েটাই মাঝে মাঝে বহুরূপী হয়ে যায় ।

পেছন থেকে এসে ইনশাকে জড়িয়ে ধরল আনিস ।ভালবাসার এক অন্যরকম অনুভূতি ।

-“আজ আমার লক্ষ্মীর মন কি অনেক ভাল নাকি একটু ভাল ?”

আদুরে কন্ঠে আনিসের প্রশ্ন ।

-“হুম…কেনো ?”

-“আমাকে দেওয়ার মত সময় কি হবে আপনার ?”

-“উঁহ… ঢং করো না ।কি বলবে বলো ?”কৃত্রিম রাগের কন্ঠে কথাটা বলল ইনশা ।

ছাদের মধ্যখানটিতে পাতানো দোলনাটায় নিয়ে গিয়ে ইনশাকে বসালো আনিস ।

পেছন থেকে দোল দিতে দিতে বলল-ইনশা ,তোমার মনে আছে ?

যখন তুমি আমার নব পরিণিতা ,তখন এমনই এক বিকেলে তুমি আমায় প্রশ্ন করেছিলে –

‘তোমাদের ছাদে দোলনা আছে ?’আমি জানতে চেয়ে ছিলাম-‘কেনো ?’

তুমি বলেছিলে……..

‘আমার দোলনা খুব প্রিয় ।দোলনা চড়তে আমার খুব ভাল লাগে ।’ কথাটা শেষ করে দিল ইনশা ।

হুম ,আর তার পরদিনই গিয়ে এই দোলনাটা নিয়ে এলাম আমি ।তোমার সে কি আনন্দ !:-D!

হ্যাঁ মনে আছে ।

-“ইনাশা !এখন যে তুমি আর আগের মত দোলনা খেলো না ?” আবেগ মাখা কন্ঠ আনিসের ।

-“এখন আমার কিছুই ভাল লাগে না ,আগের মত ।সব বিষন্ন মনে হয়…….”একটা দীর্ঘশ্বাস ,ইনশার ।

-“কেনো ভালো লাগে না ?কেনো অমন বদলে যাচ্ছো তুমি ?”

-“জানিনা…” আবার সেই দীর্ঘশ্বাস ।

-“কেনো ?কেনো তুমি তোমার দুঃখ গুলো মনে চেপে রেখেছো ?আমার সাথে ভাগ করে নাও ।”

নীরবতা….

-“অমন চুপ করে থেকো না ।তোমার যা সমস্যা আমাকে বলো ।আমি শুনব ,তোমার সব কথা ।” বলল আনিস ।

আবার নীরবতা ,আনিস অপেক্ষা করছে ইনশার বলার ।

-“আনিস ,আমি তানপুরার সুর শুনতে পাই ।প্রতি রাতে কে যেন আমায় ফোন করে ঐ সুর শোনায় ।

মাতাল করা সুর ,আমাকে খুব আকর্ষন করে ।ঐ সুর আমাকে ডাকে খুব নিবিড়ে….

খানিক চুপ হয়ে গেলো ইনশা ।এই মুহূর্তে তাকে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ।বুকের খুব গভীরে ইনশার জন্য মায়া অনুভব করল আনিস ।

-“তারপর…”

-“সেই সুর আমাকে হারিয়ে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে ।কোথায় ?তা জানিনা,শুধু জানি আমিও হারাই সেই সুরে….

এভাবে তার মনের না বলা কথা গুলো বলতে থাকে ইনশা ।

রাতে ঘুমহীন চোখে বারান্দায় পায়চারি করছে আনিস ।

প্রচন্ড গতিতে ভাবনা চলছে তার মাথায় ।রূমে ফিরে এল ,ইনশা ঘুমোচ্ছে ।তার পাশে গিয়ে শুয়ে রইল সে ।

এখন ও ভাবনা চলছে ,”কি করবো ? ইনশাকে আমি হারাতে চাই না ।বাঁচব না একটা মুহূতর্ত ওকে ছাড়া ।

আমি তোমায় অনেক ভালবাসি,অনেক ভালবাসি তোমাকে ,ইনশা !!…..

[৬]

এখন অনেক রাত ।চোখে ঘুম নেই আনিসের ।প্রচন্ড রকমের ভয় কাজ করছে মনের ভিতরে ,ইনশাকে হারাবার ভয় ।

রূমের একমাত্র ইজিচেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে ।

অদ্ভুত এক অস্পষ্ট শব্দে চোখ মেলে চাইল সে ।ভাবল ,ইনশার বুঝি ঘুম ভাঙলো ।

চোখ মেলে চাইল ইনশার দিকে ,এখনো ঘুমাচ্ছে সে ।তবে শব্দটা কিসের ? কান খাড়া রেখে শব্দটা ভালভাবে শোনার চেষ্টা করল।

শুনতে শুনতে হঠাত্‍ই চোখ বড় করে ফেলল সে ।অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে–তানপুরা !! -“হ্যাঁ ,তাইতো ।”

এখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে ।-“অদ্ভুত !সত্যিই অদ্ভুত !”বলতে বলতে চিন্তা করছে ইনশার বলা সেই দিনের কথা গুলো ।

(আনিস নিজেও একসময় তানপুরা বাজাত ।তবে সে সুর আর এ সুরে আকাশ-পাতাল তফাত্‍,একেবারেই আলাদা ।)

ইনশার কথাই ঠিক -“কেমন মাতাল করা ,নেশা ধরানো সুর ।” আপন মনেই কথাটা বলল সে ।

আর ভাবতে লাগল ইনশা কেন এই সুর শুনে আর ইনশা থাকে না । ভাবনায় এতটাই মগ্ন ছিল ,ইনশা যে জেগে গেছে তা তার নজরে পড়েনি ।

তবে একি! যে ইনশা জেগে উঠেছে সে আনিসের ইনশা নয় ,পরিবর্তিত ইনশা ।। ক্ষনিকের জন্য আনিসও নিজেকে হারিয়েছিল ,মন্ত্রমুগ্ধ তানপুরার সুরে ।

তাই ইনশার পরিবর্তনটা হঠাত্‍ই খেয়াল করল সে । কিন্তু দেরি করে ফেলেছে অনেক ।ততক্ষনে বেড রূমের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেছে ইনশা ।

লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে ছুটল ইনশার পিছু ।-“ইনশা… ইনশা …. ইনশা…….”

কোনো সাড়া নেই ইনশার ,ঘোরের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে সে ।যেন কোনো অজানা ,অদৃশ্য শক্তি টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে ,নিজের দিকে ।

আর ও কয়েকবার বৃথাই ডাকল আনিস ,জানে ইনশা সাড়া দিবে না ।এভাবে ইনশাকে ধরতে পারবে না বুঝতে পেরে ,দৌড়াতে শুরু করল সে ।

হলঘর পেরিয়ে বাড়ির প্রধান দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল ইনশা ।জোরে ডাক ছাড়ল আনিস -“ইনশাশা……”

দাঁড়াল না ইনশা ,এগিয়ে চলল বাগানের দিকে ।

আনিস ও দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে ছুটল বাগানের দিকে ।

ইনশাকে দেখতে পেল ,হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে ।

-“নাহ্ ইনশা ,ইনশা নাহ্ ,যেও না ঐদিকে ,ফিরে এসো ,ফিরে এসো …..”

সামনে শুধুই অন্ধকার ,গহীন অন্ধকার ,কাল কুচকুচে অন্ধকার ।সব ঘোলা দেখছে আনিস ,চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ব্যর্থতার অশ্রু ।

এত চেষ্টা করেও ইনশাকে ধরে রাখতে পারেনি সে ।হারিয়ে গেছে তার ইনশা তার জীবন থেকে ।রাতের অন্ধকারে সে হারিয়ে ফেলেছে–তার ইনশাকে ।

আর কোনোদিন ফিরে পাবে না ইনশাকে অথবা ইনশাই আর ফিরে আসবে না তার কাছে ।চির চেনার মাঝে সবই রয়ে গেল অচেনা !

মাথাটা ভীষন রকমে ঘুরছে আনিসের ।আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে ।

চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে……………………….

-“আনিস .এই আনিস ।ওঠো !আজ এত বেলা করে ঘুমাচ্ছো কেনো ? আনিস ,,,

চোখ মেলে চাইল আনিস ।বুঝতে চেষ্টা করল ,কোথায় আছে সে ?

ঘুমের ঘোর একটু কাটতেই শুনল ,কে যেন ডাকছে তাকে ?

-“আনিস ,এই আনিস….”

কন্ঠটা কেমন পরিচিত লাগল ,চোখ পুরোপুরি খুলল সে ।মাথাটা ঘুরিয়ে দেখল ,কে ?

ইনশা !! চোখ কচলে উঠে বসল আনিস ।কি দেখছে সে ?

কাকে দেখছে সামনে ?যা দেখছে ভুল দেখছে নাতো ?জট পাকিয়ে যাচ্ছে সব ।

-“কি হল ,এভাবে তাকিয়ে কি দেখছো ?” বলল মেয়ে কন্ঠটা ।

সব জট যেন আস্তে আস্তে খুলছে আনিসের ।নির্মল আকাশের মত পরিষ্কার বুঝতে পারছে সব ।

ভুল না ইনশাকেই দেখছে সে -জলজ্যান্ত ইনশা ।খুশিতে ভরে উঠল তার মন ।

ইনশার একটা হাত ধরে তাকে টেনে আনল খুব নিবিড়ে ।

ইনশার মাথাটা তার বুকে রেখে ,ভালবাসার এক গভীর পরশ বুলিয়ে দিল ইনশার কপোলে ।

-“আমাকে কখনো ছেড়ে চলে যেও না ,লক্ষ্মী ।এক মুহূর্ত বাঁচবনা তুমিহীনা !!”

আনিসের কথা কিছুই বুঝতে পারল না ইনশা ।কোনো প্রশ্ন ও করল না ,চুপটি করে রইল লক্ষ্মী মেয়ের মত ।

অবসান ঘটলো আনিসের আকাঙ্খাহীন–”অনাকাঙ্খিত স্বপ্নের ।”

-মাহমুদা বন্যা-

Related posts

Leave a Comment